সময় এখন পরিবর্তনের

প্রাচীন বিজ্ঞানীগণ তত্ত্ব দিয়েছিলেন যে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে আবর্তন করে। অধরা চাঁদের মাটিতেও একসময় মানুষ পা রাখতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের তৃতীয় দ্রুত বর্ধমান অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার পথে। এই সবকিছুই একটি চলমান বিষয়ের উদাহরণ এবং সেটি হলো ‘পরিবর্তন’। শত শত ‘পরিবর্তন’ তৈরি হয়ে যেতে পারে মুহূর্তের মধ্যে। কিন্তু ‘পরিবর্তন’ আসেনি ১৬০ বছর ধরে বিরাজমান দণ্ডবিধি ১৮৬০-তে ধর্ষণের সংজ্ঞায়। এ রকমই আরো কিছু আইনের ধারার পরিবর্তন এখন অতীব জরুরি।

সাধারণভাবে ধর্ষণ হচ্ছে কোনো ব্যক্তির সঙ্গে তার অনুমতি ব্যতীত কিংবা জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা। কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে সংবিধিবদ্ধ দণ্ডবিধি ১৮৬০-তে খুবই সংকীর্ণভাবে ধর্ষণকে একটি লিঙ্গনির্দিষ্ট অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এই আইনের ধারা ৩৭৫ অনুযায়ী ধর্ষণ বলতে ‘যৌনসঙ্গম’কে বোঝানো হয়েছে, কোনো পুরুষের দ্বারা কোনো নারীর বিরুদ্ধে সেই নারীর সম্মতি ব্যতীত এবং যে নারী তার স্ত্রী নয়। এই সংজ্ঞায়ন থেকে এটি স্পষ্ট যে অন্যান্য লিঙ্গের বিরুদ্ধে সংঘটিত ধর্ষণের অপরাধকে সম্পূর্ণ অদৃশ্য রাখা হয়েছে। অন্যদিকে এই ধারায় কোনো নারীর সম্মতির সংবিধিবদ্ধ বয়স হিসেবে ১৪ বছরকে নির্ধারণ করা হয়েছে, যার অর্থ ১৪ বছরের কম বয়সি কোনো নারির সঙ্গে কোনো পুরুষ যৌনমিলনে লিপ্ত হলে (যিনি তার স্ত্রী নন) তা সর্বদাই আইনের চোখে ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে। কারণ এই ধারার ব্যাখ্যা অনুযায়ী এই বয়সের কম বয়সি মেয়েরা যৌনমিলনের সম্মতি দিতে অক্ষম। সুতরাং বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে তখনই গণ্য করা হবে, যদি কোনো পুরুষের স্ত্রীর বয়স ১৪ বছরের নিচে হয়। এটি যেমন বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ, তেমনি অন্যান্য যেকোনো বয়সের নারীর বিরুদ্ধে বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে অদেখা করা হয়েছে। অন্যদিকে তিন বার সংশোধিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ ও দণ্ডবিধিতে সংজ্ঞায়িত ধর্ষণের সংজ্ঞাকেই ধরে রেখেছে। তবে একটি সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যার মাধ্যমে, যার পরিধির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে জালিয়াতির মাধ্যমে প্রাপ্ত সম্মতি। সংজ্ঞায়নের সংকীর্ণতা এবং আইনি জটিলতা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করছে দিনের পর দিন।

ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির জন্য সবচেয়ে অবমাননাকর বিষয় হলো সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২-এর ধারা ১৫৫ (৪)। এই ধারা অনুযায়ী যদি কোনো পুরুষ ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির জন্য অভিযুক্ত হন, তাহলে তিনি বা তার আইনজীবী এটা দেখাতে পারেন যে অভিযোগকারী (নারী) অনৈতিক চরিত্রের ছিলেন। এই ধারার অনুশীলনে ক্ষতিগ্রস্ত নারীকে অভিযুক্তের আইনজীবীর দ্বারা এমন জেরার মুখে পড়তে হয় যে তার মানসিক স্বাস্থ্য, মর্যাদা, ব্যক্তিত্ব, স্বাধীনতা আরো ভূলণ্ঠিত হয়। তার জীবনধারা, স্বাচ্ছন্দ্য এবং সবচেয়ে বেশি তার পোশাকের স্বাধীনতাকে বারবার আঘাত করা হয়। এর মাধ্যমে ভুক্তভোগী নারীকে উলটো দোষী করার প্রত্যক্ষ বৈধতা দেওয়া হয়, যা সমাজে প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত ‘ভিকটিম ব্লেমিং’ সংস্কৃতির প্রতিফলক। এই ধারা যৌনতাবাদী আইনব্যবস্থারই নির্দেশক। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, এই আইন সংস্কারের জন্য বাংলাদেশের আইন কমিশনের তরফ থেকে সুপারিশ করা হলেও সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।


আদিবা জাহান পায়েল
Ittefaq Link