লেখার এই শিরোনামের ধৃষ্টতার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। কিন্তু না লিখে পারছি না বর্তমান মহাদুর্যোগ করোনাকালীন প্রেক্ষাপটে। সারাবিশ্ব যেখানে ভীতসন্ত্রস্ত মৃত্যু ও আক্রান্তের ভয়ে, সেখানে একের পর এক নারী ও শিশু ধর্ষণ এবং নির্যাতনের ঘটনায় বিচার-সালিশের মাধ্যমে নারী ও শিশুকেই দোষী সাব্যস্ত করছেন সমাজপতিরা। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া এমন কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করছি এখানে।
গত ২৯ মে রাতে অমর কুমার নামে মুচি সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি এক প্রবাসীর স্ত্রীকে ধর্ষণ করে। নির্যাতিত ওই গৃহবধূ পরের দিন অমর কুমারের নামে থানায় ধর্ষণ মামলা করলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। কিন্তু বিপত্তি ঘটায় আমাদের সমাজপতিরা। তারা গত ৯ জুন গ্রাম্য সালিশ ডেকে ওই গৃহবধূকে অন্য ধর্মের ছেলের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করার অপবাদ দিয়ে এক লাখ টাকা জরিমানা করে। শুধু তাই নয়, সালিশে আসতে দেরি হওয়ায় ওই গৃহবধূর বাবাকেও এক হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। নাটোরের স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানসহ গ্রামপ্রধানরা সালিশে এই রায় দেন। (সমকাল, ১১ জুন ২০২০)।
মাদারীপুর সদর উপজেলার পেয়ারপুর ইউনিয়নের কুমারখালী গ্রামের ৮ম শ্রেণি পড়ুয়া এক কিশোরীকে অপহরণের পর ধর্ষণ করে সোহাগ মুন্সী (২২) নামের এক ব্যক্তি। এই ঘটনায় পেয়ারপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান, সবুর মেম্বার, শহিদ মেম্বারসহ অর্ধশত লোকের উপস্থিতিতে ধর্ষকের সঙ্গে ওই কিশোরীকে জোরপূর্বক বিয়ে দেন স্থানীয় চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান। অসহায় কিশোরীর বাবা বলেন, আমি গরিব মানুষ, চেয়ারম্যানের পায়ে ধরেছি। কিন্তু তিনি আমার কোনো কথা শোনেননি। আমার নাবালিকা মেয়েটিকে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলেন (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৫ জুলাই ২০২০)।
কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে গত বছরের নভেম্বরে আপন চাচা তার ভাইয়ের কিশোরী মেয়েকে ধর্ষণ করে। ধর্ষণের ফলে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে বিষয়টি জানাজানি হয়। পরে কিশোরীর বাবার করা ধর্ষণ মামলায় চাচা সোহেলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গত জুন মাসের শেষে ওই কিশোরী সন্তান জন্ম দেয়। কিশোরীর ভাই অভিযোগ করে বলেন, চাচা সোহেল গ্রেপ্তার হওয়ার পর এলাকাবাসী তার জামিনের জন্য একাধিকবার বৈঠকে বসে এবং আমার দাদা ও অন্য আত্মীয়রা মিলে আমার বাবাকে হুমকি দিতে থাকে- মামলা না তুললে আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হবে। এমতাবস্থায় বাবার নিমরাজিতে চাচার জন্য জামিনের আবেদন করা হয় এবং তিনি জামিনে বেরিয়ে আসেন। এই কুকীর্তিমান ছেলেকে দাদা, ফুফু ও নিকটাত্মীয় অনেকেই গলায় ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে। এখানেই ঘটনা শেষ নয়, তারপর চাচা সোহেল মোটরসাইকেলে এলাকায় শোডাউন করে। ওই কিশোরী বলে, আমার মা-বাবা বাড়িতে না থাকায় চাচা আমাকে চার দিন ধর্ষণ করে এবং এই ঘটনা কাউকে জানালে হত্যা করার হুমকি দেয়। (সমকাল, ২১ জুলাই ২০২০)
মাগুরা জেলার মহম্মদপুর, নহাটা থানা এলাকায় অষ্টম শ্রেণি (১৫) পড়ুয়া কিশোরীর সঙ্গে ভাঙ্গুড়া গ্রামের কলেজছাত্র শাহাবুল ইসলামের (১৯) প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মেয়েটিকে ধর্ষণ করে শাহাবুল। ফলে মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। কিশোরীর চাচা এই ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে মহাম্মদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নহাটা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তফা সিদ্দিকী লিটনের কাছে যান। যাওয়ার দু’দিন পর ১০ জুলাই ভুক্তভোগী পরিবারের বাড়ির পাশে এক জায়গায় সালিশ বসানো হয়। মোস্তফা সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ওই সালিশে শতাধিক মানুষ উপস্থিত ছিল। সালিশে বিয়ের আগে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার অভিযোগে ভুক্তভোগী পরিবারকে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। টাকা পরিশোধের জন্য ১০ দিনের সময় বেঁধে দেওয়া হয়। এমনকি একই সঙ্গে ছয় মাসের জন্য পরিবারটিকে সমাজচ্যুত করেন সালিশকারীরা। সেইসঙ্গে বিষয়টি নিয়ে পুলিশের কাছে না যাওয়ার জন্যও পরিবারটিকে হুমকি দেওয়া হয়। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারটি সালিশকারীদের কথিত ধার্য করা জরিমানার টাকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় গত ২০ জুলাই নহাটা ইউনিয়নের সাবেক সদস্য ওবায়দুর রহমানের নেতৃত্বে সালিশকারীরা ভুক্তভোগীদের বাড়িতে চড়াও হয়। তারা বাড়ি থেকে একটি গরু, চারটি ছাগল, একটি সাইকেল, ভ্যান, শ্যালো মেশিনসহ বেশ কিছু জিনিস ছিনিয়ে নিয়ে যায়। (প্রথম আলো, ২১ জুলাই ২০২০)। ঘটনার পর ওই আওয়ামী লীগ নেতা আত্মগোপন করে থাকলেও তার অনুসারীরা নির্যাতিতার পরিবারকে প্রতিনিয়ত হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। ফলে পরিবারটি চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। এদিকে নহাটা গ্রামে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অভিযুক্ত এই সাবেক চেয়ারম্যান এরকম আরও অনেক সালিশের সঙ্গে জড়িত। সব সালিশেই এরকম জরিমানা করেছেন। তবে ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারছে না। (বাংলা ট্রিবিউন, ২৪ জুলাই ২০২০)।
এরকম বহু ঘটনা আমাদের সমাজপতিরা ঘটিয়ে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। এভাবেই তারা সমাজের নির্যাতনকারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন। সমাজের প্রতিনিধি যারা আছেন, তারা যদি নির্যাতিতার ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করতেন, তাহলে নির্যাতনকারীরা অন্যায় করার আগে ভাবত যে, অন্যায় করে সমাজে পার পাওয়া যাবে না। পরিবার ও সমাজের বিরূপ ভূমিকার জন্য নির্যাতনকারী অন্যায় করে পার পেয়ে যাচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অসহযোগিতার জন্যও নির্যাতিতারা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গত মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত এই দুর্যোগের মধ্যেও পাঁচ মাসে ৫১৯ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ২৮ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এদের ১২ জনের বয়স ১৮ বছরের নিচে ও ৫ জন ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা করেছে। এর মধ্যে ৪ জনের বয়স ১৮ বছরের কম। এছাড়া ৯৯ জন নারী ও শিশুর ওপর ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে। যার মধ্যে ৭৩ জনই শিশু। আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে নারী নাকি পোশাকের জন্য ধর্ষিত হয়। তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, তাহলে এই সমাজের শিশুরা কেন ধর্ষিত হচ্ছে, সেখানে কিন্তু ছেলে শিশুও রয়েছে। তাই পরিবার, সমাজে তথাকথিত সালিশকারী ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের বিনীত আহ্বান জানাই, আপনারা ধর্ষকদের পক্ষে সাফাই না গেয়ে নির্যাতিতার পাশে দাঁড়ান, তাদের ন্যায়বিচার পেতে সহায়তা করুন। তাহলেই সমাজে নির্যাতকের সংখ্যা হ্রাস পাবে। আর নির্যাতিতা দ্বিতীয়বার সামাজিকভাবে নির্যাতনের হবে না।
নার্গিস আক্তার
গবেষক, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)
সমকাল লিঙ্ক