করোনাকালে পারিবারিক সহিংসতা

যে কোনো দুর্যোগকালীন সময়ে কিংবা জরুরি পরিস্থিতিতে নারী ও কন্যাশিশুদের প্রতি সহিংসতা বিশেষ করে পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে। করোনার মতো সংক্রামক ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বিশ্বের অনেক দেশেই লকডাউন চলছে। এ ভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে পৃথিবীর মানুষ ঘরে অবস্থান করছে। করোনার জন্য ঘরকেই সর্বোচ্চ নিরাপদ স্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও অনেক নারী ও কন্যাশিশুর জন্য ঘরও অনিরাপদ হয়ে ওঠে। কেননা এ সময় তারা তাদের পরিবারের সদস্য ও স্বামী দ্বারাই বেশি নির্যাতন ও অবমাননার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। দিন যত গড়াতে থাকবে স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, অর্থ ইত্যাদি সংক্রান্ত নানা দুশ্চিন্তা এ ধরনের সহিংসতা আরও বাড়াবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সবাই ঘরে থাকছে বলে নারীর কর্মব্যস্ততা বেড়ে গেছে- ঘরের কাজ, অফিসের কাজ, বাচ্চার দেখভাল, বয়স্কদের যত্ন- সব কিছু মিলিয়ে নারীকে পাড়ি দিতে হচ্ছে এক কঠিন সময়। এর সঙ্গে রয়েছে নির্যাতন। এ সময় বিভিন্ন দেশের সংবাদমাধ্যম পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধির সংবাদ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করছে। ভারত, আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স, চীন, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, হন্ডুরাস, দক্ষিণ আফ্রিকা, মালয়েশিয়া, লেবানন, সিঙ্গাপুর, সাইপ্রাস প্রভৃতি দেশে এ ধরনের সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ভারতে ন্যাশনাল কমিশন অন ওমেনের তথ্যানুযায়ী, মার্চের প্রথম সপ্তাহে তাদের কাছে নারীর প্রতি সহিংসতার ১১৬টি অভিযোগ আসে, মার্চের শেষ সপ্তাহে আসে ২৫৭টি। এর মধ্যে পারিবারিক সহিংসতার অভিযোগ ৩০টি থেকে বেড়ে ৬৯টিতে পৌঁছেছে। এ চিত্র এমন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে যে, সম্প্রতি জাতিসংঘের মহাসচিব এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি পরিস্থিতি মোকাবিলায় জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর জোর দিয়েছেন। সব দেশের সরকারগুলোকে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নে এ বিষয়গুলোকেও আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ করোনাভাইরাস মোকাবিলার পাশাপাশি পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও প্রতিকারেও ব্যবস্থা নিচ্ছে। আর্জেন্টিনাতে ফার্মেসিগুলোকে সহিংসতার শিকার নারীদের অভিযোগ দায়েরের জন্য নিরাপদ স্থান হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ফ্রান্সেও একই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ফার্মেসিতে জানানোর পর কর্তৃপক্ষ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। এ ছাড়া ফ্রান্সে ২০ হাজার হোটেল রুম ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বাড়ি ফিরতে না পারা নারীদের জন্য। স্পেনে সহিংসতার শিকার বা আশঙ্কা করছে, এমন নারীদের জন্য লকডাউন শিথিল করা হয়েছে, যাতে তারা বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ স্থানে যেতে পারে। ইতালিতে একটি অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে, যার মাধ্যমে ফোন কল ছাড়াই নারীরা সহজে সহযোগিতা চাইতে পারে। কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া করোনা প্রতিরোধে গৃহীত তাদের জাতীয় কর্মকৌশলে নারীর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অর্থ বরাদ্দ রেখেছে।

এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারের দ্রুততার সঙ্গে করোনা মোকাবিলায় যে পরিকল্পনা গ্রহণ করছে, সেখানে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও প্রতিকার বিধানের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা ও সেগুলো কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য অর্থ বরাদ্দ করা আবশ্যক। বিদ্যমান হেল্পলাইন নম্বরগুলো সবার কাছে ছড়িয়ে দিতে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। হেল্পলাইন নম্বরগুলোকে আরও বেশি সক্রিয় করে তোলা প্রয়োজন। কেননা, এ নম্বরগুলোতে ফোন দিলে প্রায়ই কেউ ধরে না বলে অভিযোগ রয়েছে। কোনো অভিযোগ এলে তার প্রতিকারে ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। টেক্সট মেসেজ পাঠানোর সুযোগ চালু করা, যাতে করে যারা কল দিতে পারছে না, তারা মেসেজ পাঠিয়ে সহযোগিতা চাইতে পারে। কোনো একটা বিশেষ অ্যাপও তৈরি করা যেতে পারে। এ ছাড়া অনলাইনে আইনি পরামর্শ ও কাউন্সেলিং সেবা প্রদান করা যায়। সহিংসতার শিকার নারী ও কন্যাশিশুদের আশ্রয় প্রদানের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা সম্পন্ন আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, মানবাধিকার ও আইন সহায়তা প্রদানকারী সংগঠনগুলোর সমন্বয় সাধন করা যায়। এ ধরনের সংগঠনগুলোর অনেকেরই হেল্পলাইন আছে এবং সহায়তার জন্য এসব নম্বরে অনেকেই যোগাযোগ করেন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সব সংগঠনের পক্ষে এসব সহায়তা প্রার্থীদের সহযোগিতা ও আশ্রয় প্রদান নাও সম্ভব হতে পারে। সে ক্ষেত্রে এসব সংগঠনের সঙ্গে সরকারের সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষ সমন্বয়ের মাধ্যমে সেবা প্রদানের ব্যবস্থা নিতে পারে।


তামান্না হক রীতি, মানবাধিকার কর্মী, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)
Samakal Link