পাবলিক পরীক্ষায় অপরাধ

সাম্প্রতিক সময়ে পরীক্ষাসংক্রান্ত অপরাধ

সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের ব্যাপারটি আলোচিত হয়ে আসছে। বিগত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংক, সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ পরীক্ষা, প্রথম শ্রেণী থেকে শুরু করে প্রায় সব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় নিয়মিত প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনা ঘটছে।

গত নভেম্বর মাসে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ সরকারি ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের তদন্তে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক নিখিল রঞ্জন ধরের নাম আসে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করছিলেন। তাকে ওই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। দেশের একটি প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের দ্বারা অপরাধমূলক কর্মকান্ড কোনোভাবে প্রত্যাশিত নয়।

পাবলিক পরীক্ষাসংক্রান্ত আইন

আমাদের দেশে পাবলিক পরীক্ষাসংক্রান্ত অপরাধের প্রতিরোধ ও শাস্তির বিধান করার লক্ষ্যে পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইন-১৯৮০ করা হয়েছে। আইনটিতে পাবলিক পরীক্ষাসংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের অপরাধের শাস্তির বিধান রয়েছে।

আইনটির ধারা ২(ঘ) অনুযায়ী- এমন কোনো পরীক্ষা, যা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা বোর্ড কর্তৃক অনুষ্ঠিত, পরিচালিত, নিয়ন্ত্রিত বা সংঘটিত হয় তাকে পাবলিক পরীক্ষা বলে।

ধারা ৩ অনুসারে- যদি কোনো ব্যক্তি অন্যের হয়ে পরীক্ষা দেয় বা নিজে পরীক্ষার্থী না হয়ে, পাবলিক পরীক্ষার সময় পরীক্ষার হলে প্রবেশ করে নিজেকে পরীক্ষার্থী হিসেবে ঘোষণা করে, তাহলে উক্ত ব্যক্তি সর্বনিম্ন থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত হবে।

ধারা ৪ আনুসারে- যদি কোনো ব্যক্তি কোনো পাবলিক পরীক্ষার আগে উক্ত পরীক্ষার জন্য তৈরিকৃত কোনো প্রশ্ন প্রকাশ করে বা বিতরণ করে, তাহলে উক্ত ব্যক্তি সর্বনিম্ন তিন থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন পাশাপাশি অর্থদন্ডেও দন্ডিত হবেন। যদি কোনো ব্যক্তি এমন কোনো প্রশ্ন প্রকাশ করে বা বিতরণ করে যা আদতে উক্ত পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন না কিন্তু তিনি সে প্রশ্নটিকে উক্ত পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন বলে প্রকাশ করেন, ধারা ৪ তার ওপরেও বর্তায়।

ধারা ৫ অনুযায়ী- যদি কোনো ব্যক্তি কোনো পাবলিক পরীক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো মার্ক, মার্কশিট, ট্যাবুলেশন শিট, সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা বা ডিগ্রি যে কোনো উপায়ে পরিবর্তন করেন, সে চার বছর পর্যন্ত কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন এবং অর্থদন্ডেও দন্ডিত হবেন।

ধারা ৬ অনুসারে- যদি কোনো ব্যক্তি কোনো পাবলিক পরীক্ষা-সম্পর্কিত কোনো মিথ্যা মার্কশিট, সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা বা ডিগ্রি তৈরি করেন, প্রিন্ট করেন, বিতরণ করেন বা ব্যবহার করেন, তাহলে উক্ত ব্যক্তি সর্বনিম্ন তিন থেকে সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন, পাশাপাশি অর্থদন্ডেও দন্ডিত হবেন।

ধারা ৮ অনুযায়ী- যদি কোনো ব্যক্তি কোনো পাবলিক পরীক্ষা সম্পর্কিত কোনো উত্তরপত্র বা তার একটি অংশ প্রতিস্থাপিত করেন, বা একটি উত্তরপত্রের সঙ্গে কোনো অতিরিক্ত পৃষ্ঠা যোগ করে যা তার নিজের লেখা নয়, তাহলে উক্ত ব্যক্তি সর্বনিম্ন তিন থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন, পাশাপাশি অর্থদন্ডেও দন্ডিত হবেন।

ধারা ৯ অনুসারে- যদি কোনো ব্যক্তি পরীক্ষার কক্ষে কোনো পরীক্ষার্থীকে কোনো বই বা লিখিত পত্র সরবরাহ করেন, মৌখিকভাবে বা যে-কোনো যান্ত্রিক উপায়ে কোনো উত্তর বলে দেন, তাহলে উক্ত ব্যক্তি সর্বনিম্ন দুই থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন, পাশাপাশি অর্থদন্ডেও দন্ডিত হবেন। বর্তমানে বিভিন্ন ডিজিটাল মাধ্যম (ডিভাইস ও অ্যাপস) ব্যবহার করে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনেও মামলা হয়েছে। যার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও মামলা হচ্ছে। এ দুটি আইনে করা মামলাগুলো ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল ও ঢাকার সিএমএম আদালতে বিচারাধীন।

ধারা ১১ অনুযায়ী- যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে বাধা দেয়, তাহলে উক্ত ব্যক্তি সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদন্ডে অথবা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।

ধারা ১২ অনুসারে- যদি কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধ সংঘটনে কাউকে উৎসাহিত করেন বা নিজে চেষ্টা করেন, তাহলে সে ব্যক্তি ওই অপরাধের জন্য প্রদত্ত শাস্তি ভোগ করবেন।

ধারা ১৪ অনুযায়ী- এ আইনের অধীনে কোনো অপরাধ আমলযোগ্য হবে।

আইনের বিশ্লেষণ

আইনটির বিভিন্ন ধারায় পাবলিক পরীক্ষায় বিভিন্ন ধরনের অপরাধের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। তবে আইনটির কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আইনের ২(ঘ) ধারায় প্রদত্ত পাবলিক পরীক্ষার সংজ্ঞা অনুযায়ী শুধু বিশ্ববিদ্যালয় ও বোর্ড কর্তৃক আয়োজিত পরীক্ষাই পাবলিক পরীক্ষা বলে বিবেচিত হবে। সেজন্য যে কোনো চাকরির পরীক্ষায় সম্পাদিত কোনো অপরাধ এ আইনের এক্তিয়ারে পড়ে না। আবার গত কয়েক বছরে বিভিন্ন ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনেও মামলা হয়েছে।

একটি রিপোর্ট অনুযায়ী- ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পাবলিক পরীক্ষা আইন, আইসিটি আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মোট ২০০টি মামলা করা হয়, যার মধ্যে ৪৫টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। নিষ্পত্তি হওয়া মামলার মধ্যে সাজা হয়েছে মাত্র একটি মামলাতে। এসব মামলার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তদন্তে দুর্বলতা, ভুল আইনে মামলা ও অভিযোগপত্র দেওয়া, সাক্ষীকে হাজির না করায় আসামিরা অব্যাহতি বা খালাস পেয়েছেন।

নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে পরীক্ষার্থীকে লিখিত কাগজ সরবরাহ ও মৌখিক বা যান্ত্রিক উপায়ে সাহায্য করার অভিযোগে ৩১টি মামলা, ভুয়া পরীক্ষার্থী হয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অভিযোগে ছয়টি মামলা, প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে পাঁচটি মামলা এবং ভুয়া সার্টিফিকেট তৈরির অভিযোগে তিনটি মামলা রয়েছে।

২০১৮ সালে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে অফিস সহায়ক পদে মৌখিক পরীক্ষা দেওয়ার সময় ধরা পড়েন ভুয়া পরীক্ষার্থী আবিদা। তার বিরুদ্ধে পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনের ৩(ক) ধারায় মামলা করা হয়। মামলার রায়ে বলা হয়, এটি পাবলিক পরীক্ষাসংক্রান্ত কোনো অপরাধ নয়। এটা ছিল চাকরির পরীক্ষা। আসামির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ গঠনের উপায় নেই। এজন্য ২০২০ সালে আসামিকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

অভিযোগ গঠনের আগেই আসামিরা অব্যাহতি পেয়েছেন, এমন সাতটি মামলা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে- ঘটনা চাকরির পরীক্ষাসংক্রান্ত অপরাধের, কিন্তু মামলা হয় পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনে। এ কারণে চারটি মামলার আসামিরা অব্যাহতি পান।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষের যেসব ব্যর্থতায় আসামিদের সাজা হচ্ছে না, সেসব কারণ চিহ্নিত করে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। তার মতে, আইনে পাবলিক পরীক্ষার সংজ্ঞার মধ্যে চাকরির নিয়োগ পরীক্ষাসহ এ সংক্রান্ত অপরাধ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’

বিকল্প পন্থা

নিষ্পত্তি হওয়া ৪৫টি মামলার মধ্যে যে মামলায় আসামির সাজা হয়, সে মামলায় ২০১৮ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ওয়্যারলেস অপারেটর পদের নিয়োগ পরীক্ষায় আতিকুর রহমান সেজে পরীক্ষায় অংশ নেন মেহেদী শামীম। তার বিরুদ্ধে পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনের ৩(খ) ধারায় মামলা হয়। ২০২০ সালে আদালত তাকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন। রায়ে বলা হয়- ‘আসামির বিরুদ্ধে পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনের ৩(খ) ধারার অভিযোগ গঠনের উপাদান নেই। তবে আসামির বিরুদ্ধে প্রতারণার (দন্ডবিধির ৪১৯ ধারা) সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। আসামিকে অভিযোগ পড়ে শোনানো হলে তিনি দোষ স্বীকার করায় ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন আদালত।’

যখন কোনো ব্যক্তি অন্যের হয়ে কোনো পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ৪১৯ ধারায় অভিযোগ গঠন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনের ৩(ক) ধারার সীমাবদ্ধতা এড়ানো সম্ভব।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহ্দীন মালিক বলেন, ‘পুলিশ দন্ডবিধি জানে এবং দন্ডবিধির অপরাধগুলো ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী তদন্ত করা, সাক্ষী জোগাড় করা সবই তারা জানে। এখন করণীয় হলো নতুন অপরাধটা বিদ্যমান দন্ডবিধিতে একটা বা দুইটা উপধারার মাধ্যমে যোগ করে দেওয়া। যেমন পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের অপরাধটা দন্ডবিধির ৪০৫ ধারায় (অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গ) একটা উপধারা হিসেবে যোগ করে দিলেই হয়।’ যদি কোনো ব্যক্তি কোনো প্রকারের সম্পত্তি পরিচালনার ভার পেয়ে অসাধুভাবে সেই সম্পত্তি আত্মসাৎ করে বা নিজের কাজে ব্যবহারে করে কিংবা ট্রাস্ট পরিচালনা পদ্ধতির কোনো আইন লঙ্ঘন করে উক্ত সম্পত্তি ব্যবহার করে বা বিলি করে, তাহলে সে ব্যক্তি অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গের অপরাধ করেছে বলে বিবেচিত হবে।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে পরীক্ষাসংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের অপরাধ বাড়ছে। তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত আধুনিকায়নের ফলে নতুন নতুন ধরনের অপরাধের উদ্ভব হচ্ছে। এর প্রভাব পরীক্ষাসংক্রান্ত অপরাধেও দেখা যাচ্ছে। পাবলিক পরীক্ষা আইনটি ১৯৮০ সালে করা হয়। চার দশক পুরোনো আইনটির সংশোধন প্রয়োজন। আইনটির পরিধি খুবই সংকীর্ণ। আইনটির ব্যাপ্তি বৃদ্ধি করার মাধ্যমে পাবলিক পরীক্ষাসংক্রান্ত অপরাধ কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব। যার ফলে পাবলিক পরীক্ষায় অপরাধের জন্য অভিযুক্ত আসামিরা অযৌক্তিক কোনো কারণে মামলা থেকে অব্যাহতি পাবেন না।


লেখক : এম এম তানজিমুল হক, শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যে : আইন সালিশ কেন্দ্র (আসক)
প্রকাশিত লিঙ্কঃ পাবলিক পরীক্ষায় অপরাধ