ভূমিকা
ক্রিপ্টোকারেন্সি বর্তমান বিশ্বে সবসময় আলোচনায় থাকা শব্দসমূহের অন্যতম একটি। ক্রিপ্টোমুদ্রা বিটকয়েনের নাম শোনেননি এমন মানুষ খুব কমই রয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা সাধারণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী সবাই নিয়মিত ক্রিপ্টোমুদ্রা-সংক্রান্ত কোনো না কোনো বিজ্ঞাপন সামনে পেয়ে থাকেন।
বিটকয়েন ছাড়াও অন্যান্য কিছু পরিচিত ক্রিপ্টোমুদ্রা হলো ইথেরিয়াম, টেদার, বাইন্যান্স কয়েন ইত্যাদি। ক্রিপ্টোকারেন্সির বিশেষত্ব হলো, এ ধরনের মুদ্রা প্রচলন, প্রবহণ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল নয়। সেখানেই এই মুদ্রা নিয়ে মূল শঙ্কার জায়গা তৈরি হয়েছে। তবে আবার অনেকেই ধারণা করছেন, ক্রিপ্টোকারেন্সি সমগ্র মুদ্রাব্যবস্থাতেই বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে চলেছে। ফলে মানুষের মধ্যে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ করার আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে বলেই লক্ষ্য করা যায়; কিন্তু ক্রিপ্টোর বাজার এখনো ভীষণ অস্থির। শেয়ারবাজারে ক্রিপ্টো মুদ্রাগুলোর শেয়ারের মূল্য অনিয়মিত ও অনির্দেশ্যভাবে ওঠানামা করে। অপরপক্ষে মুদ্রাগুলোর বাস্তবিক কোনো ব্যবহার প্রচলিত হয়নি। নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান ও ক্ষেত্র ছাড়া এখনো উল্লেখযোগ্যভাবে কেউ তাদের পণ্য বা সেবার বিপরীতে মূল্য হিসেবে ক্রিপ্টোমুদ্রা গ্রহণ করছে না। তবুও বিনিয়োগকারীরা ভবিষ্যৎ বিপ্লবের বিশ্বাসে ক্রিপ্টোমুদ্রায় বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন।
ক্রিপ্টোমুদ্রার বেচাকেনাও একধরনের ব্যবসায় হিসেবে উপনীত হয়েছে। এ মুদ্রা কিনে লাভজনক দামে অন্যের কাছে বিক্রি করার আগ্রহ থেকেও অনেকে এই অস্থির মুদ্রা ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যাপারে শুরু থেকেই রক্ষণশীল অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশে ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেন নিষিদ্ধ। সর্বশেষ গত ১২ অক্টোবর ২০২২ তারিখের একটি প্রজ্ঞাপনে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, ভার্চুয়াল মুদ্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বাংলাদেশি গ্রাহকেরা বিভিন্ন বিদেশি ভার্চুয়াল অ্যাসেট সার্ভিস প্রোভাইডার ওয়েবসাইট বা অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে ভার্চুয়াল মুদ্রা বা ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন, ক্রয়-বিক্রয়, পুনর্বিক্রয়, হস্তান্তর ও বিনিময় ইত্যাদি কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। গ্রাহক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে এ ধরনের কোনো লেনদেন যেন সম্পন্ন না হয় তা নিশ্চিত করতে ব্যাংকগুলোকে মনিটরিং বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
মুদ্রাব্যবস্থার বিবর্তন ও ক্রিপ্টোকারেন্সি
কাগজি মুদ্রার প্রচলন আধুনিক বাজারব্যবস্থা গড়ে ওঠার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। মানবসভ্যতার প্রাথমিক লেনদেনগুলো ছিল বিনিময়নির্ভর। কিন্তু বিনিময়ের ছিল বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা। প্রথমত, মূল্যমানের সামঞ্জস্যতা রক্ষা করা বিনিময়ের ক্ষেত্রে সম্ভব ছিল না। বিভিন্ন পণ্যের মূল্যমান বিভিন্ন হওয়ায় সঠিক পরিমাণ হিসাব করে বিনিময় সম্পন্ন করা প্রায় অসম্ভব ছিল। দ্বিতীয়ত, অবিভাজ্য দ্রব্যাদি গোটা বিনিময় করতে হতো; বিনিময়ের ক্ষুদ্র একক প্রচলিত ছিল না। তৃতীয়ত, বিনিময়যোগ্য দ্রব্যের উপযোগ উভয় পক্ষের কাছে সমান হতো না। অর্থাৎ কেউ যদি কোনো ‘ক-দ্রব্য’ বিনিময় করে একটি ‘খ-দ্রব্য’ কিনতে চায় এবং প্রথম বিক্রেতার সেই মুহূর্তে দ্বিতীয় দ্রব্যটি কেনার আগ্রহ না থাকে, তাহলে বিনিময়টি সম্পন্ন করে যাবে না। চতুর্থত, বিনিময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল তারল্য। বিনিময়যোগ্য দ্রব্যাদি সর্বদা বহন করে নিয়ে বেড়ানো সম্ভব ছিল না। এ সমস্যাটি বিনিময়ের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
আধুনিক বাজারব্যবস্থার ধারণা তাই বিনিময়নির্ভর ব্যবস্থায় চিন্তা করার সুযোগ ছিল না। মুদ্রার ধারণা তাই বাজারব্যবস্থার ইতিহাসে একটি বিপ্লব। স্বর্ণ, রৌপ্য, ব্রোঞ্জ ইত্যাদি মূল্যবান ধাতুর তৈরি মুদ্রার প্রচলনের মাধ্যমে লেনদেন, বেচাকেনায় আমূল পরিবর্তন আসে। ধাতবমুদ্রার মাধ্যমে মূল্যমানের সামঞ্জস্যতা রক্ষা করে বেচাকেনার সুযোগ তৈরি হলো। বিনিময়যোগ্য ক্ষুদ্র একক পাওয়া গেল। উপযোগিতার সংকট থাকল না। ধাতুগুলো যেহেতু মূল্যবান, বিক্রেতারা সেটা নির্দ্বিধায় গ্রহণ করতে পারতেন। সহজে বহন করার সুযোগ হওয়ায় ধাতব মুদ্রা তারল্য বৃদ্ধি করল। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হলো ধাতব মুদ্রা কিন্তু নিজেই মূল্যবান ছিল, আধুনিক কাগজি মুদ্রার মতো নয়। স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে কোনো পণ্য বিক্রি করে সেই মুদ্রা দিয়ে পরে অন্য পণ্য যেমন কেনা যাবে, তেমনি স্বর্ণকে স্বর্ণ হিসেবেও সঞ্চয় করে রাখলে ক্ষতি ছিল না। আধুনিক সময়ের মুদ্রাস্ফীতির মতো ঝুঁকি কম ছিল; মূল্যবান ধাতুর মূল্য হারানোর শঙ্কাও তুলনামূলকভাবে ছিল না বললেই চলে। কিন্তু প্রকৃতিতে মূল্যবান ধাতুর পরিমাণ সীমিত হওয়ায়, আধুনিক বিশ্বায়ন এবং বৃহৎ বৈশ্বিক বাজারব্যবস্থার জন্য প্রয়োজন ছিল আরো বৈপ্লবিক মুদ্রাব্যবস্থার।
এ বিপ্লব সাধিত হয় কাগজি মুদ্রা এবং ব্যাংকনোট প্রচলনের মাধ্যমে। সপ্তম শতাব্দীতে চীনে প্রথম কাগজি মুদ্রার ব্যবহার শুরু হয়েছিল। তখনকার কাগজি মুদ্রা ছিল প্রত্যর্থপত্র (promissory note) ধরনের। আধুনিক সময়ে কাগজি মুদ্রা আরো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করলেও এর মৌলিক বৈশিষ্ট্য কিন্তু এখনো একই রয়েছে। যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক প্রচলিত ১ হাজার টাকার একটি নোটে লেখা থাকে- ‘বাংলাদেশ ব্যাংক চাহিবামাত্র ইহার বাহককে ১ হাজার টাকা দিতে বাধ্য থাকিবে।’ অর্থাৎ মুদ্রার নোটটি আসলে একটি প্রতিশ্রুতির দলিল। এর আপাত কোনো আর্থিক মূল্য নেই। দলিলটি যখন যে বহন করবে তার কাছেই বাংলাদেশ ব্যাংক উক্ত মূল্যমানের অর্থের জন্য দায়বদ্ধ থাকবে। মূলত এই দায় মেটানোর নিমিত্তেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক গোল্ড রিজার্ভ রাখে। যদিও আধুনিক অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভে থাকা স্বর্ণের সমপরিমাণ মুদ্রা প্রবাহনেই সীমাবদ্ধ থাকে না, রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন অনুযায়ী নোট ছাপাতেও পারে। আবার মুদ্রাস্ফীতি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যেতে পারে বলে ইচ্ছা হলেই ব্যাংক মুদ্রা ছাপাতে পারে না। একটি ১ হাজার টাকার ব্যাংকনোটের আর্থিক মূল্য হাজার টাকা না হলেও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রত্যয়ন বা প্রমিস সাপেক্ষে সেটি মূল্যবান ও বিনিময়যোগ্য হয়ে ওঠে।
বর্তমানে কাগজি মুদ্রার ব্যবহারও ক্রমশ কমে আসছে। কার্ড, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং ও ই-কমার্সের মাধ্যমে পৃথিবী দ্রুতই ক্যাশলেস বা নগদহীন একটি সময়ের দিকে এগিয়ে চলেছে। আজকাল মানুষের উপার্জিত সব অর্থই যেন ব্যাংকের হিসাব বিবরণীতে একটি ভুক্তি হিসেবেই থেকে যায়। লেনদেনের ভিত্তিতে হিসাব বিবরণীর ভুক্তিটিতে টাকার অঙ্ক যোগ-বিয়োগ হতে থাকে। তবে এমন ক্যাশলেস লেনদেনকে ক্রিপ্টোকারেন্সির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা যাবে না। সাধারণ সবাই মুদ্রা প্রচলন, প্রবহন ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বস্তুগতভাবে মুদ্রাগুলো গ্রাহকের কাছে না থাকলেও ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকই সবাই মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ করছে এবং গ্রাহক হিসেবে উল্লিখিত টাকার অঙ্কের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকই দায়বদ্ধ থাকছে; কিন্তু ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রচলন, প্রবহন বা নিয়ন্ত্রণের জন্য কেন্দ্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন হয় না, অন্তত এর মূল প্রস্তাবনা এটিই। ক্রিপ্টোমুদ্রা লেনদেনের জন্য কোনো ব্যাংকের প্রয়োজন হয় না, সরাসরি ব্যবহারকারীরা একে-অপরকে মুদ্রা পাঠাতে পারেন। প্রথাগত ব্যাংকনোট ছাপায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করে কী পরিমাণ মুদ্রা প্রবহন হবে। ক্রিপ্টোকারেন্সি সফটওয়্যার এলগোরিদমের মাধ্যমে তৈরি হয় এবং এর সাপ্লাই স্বয়ংক্রিয়ভাবে এলগোরিদম দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। স্বয়ং সফটওয়্যার নির্মাতারাও মুদ্রার পরিমাণ বাড়াতে বা কমাতে পারেন না। এজন্য ক্রিপ্টোকারেন্সিকে বিকেন্দ্রীকৃত মুদ্রাও (decentralised currency) বলা হয়।
ক্রিপ্টোকারেন্সি যেভাবে কাজ করে
ক্রিপ্টোকারেন্সির ধারণাটি দাঁড়িয়ে আছে ক্রিপ্টোগ্রাফি ও ব্লকচেইন প্রযুক্তির ওপর। ক্রিপ্টোগ্রাফি ব্যবহার করা হয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদির নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে। একটি কম্পিউটার থেকে ইনপুট দেওয়া তথ্য সফটওয়্যারের সিস্টেমে এনক্রিপ্টেড অবস্থায় সংরক্ষিত হয়, যাতে শুধু সফটওয়্যারটির প্রটোকল ব্যবহার করে উক্ত তথ্যে প্রবেশাধিকার রয়েছে এমন কেউ তথ্যটি সংগ্রহ করতে পারে। ক্রিপ্টোকারেন্সি ছাড়াও ইন্টারনেট নিরাপত্তায় ক্রিপ্টোগ্রাফির বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে। অন্যদিকে ব্লকচেইন প্রযুক্তিটি হলো সেই বৈপ্লবিক উদ্ভাবন, যার ওপর ক্রিপ্টোকারেন্সির মতো বিকেন্দ্রীকৃত মুদ্রাব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে। সহজ করে বললে আধুনিক সময়ে আমাদের সবাই অর্থ নির্ভর করছে ব্যাংকের হিসাব বিবরণীতে থাকা একটি ভুক্তির ওপর। ব্যাংক একটি মধ্যবর্তী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবরণীটি নিয়মিত আপডেট করে। এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে একজন মানুষ হিসাবরক্ষক হিসেবে কাজ করেন। এই ব্যবস্থার ভিত্তি হলো ব্যাংকের প্রতি আমাদের ট্রাস্ট। আমরা বিশ্বাস রাখি যে ব্যাংক খেয়ালখুশিমতো স্প্রেডশিটে ডেটার এন্ট্রি পরিবর্তন করবে না। আধুনিক সময়ে ব্যাংকের সার্ভারে যখন সাইবার আক্রমণ হয়, তাতে এই ডেটার এন্ট্রিই পরিবর্তন করে অর্থ হ্যাকারদের অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়। ব্লকচেইন প্রযুক্তিও একটি ডেটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম।
ব্লকচেইনে হিসাবরক্ষক হিসেবে কোনো মানুষকে কাজ করতে হয় না। একটি লেনদেন সম্পন্ন হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ডাটা আপডেট হয়; কিন্তু কেবল স্বয়ংক্রিয় আপডেট হওয়া তো কোনো যুগান্তকারী ব্যাপার নয় এবং এটি তো এখনো হ্যাক হতে পারে। সেখানেই ব্লকচেইনের যুগান্তকারী প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন। ব্লকচেইনে ডেটা কোনো একক কম্পিউটারে থাকে না। একই তথ্য পৃথিবীজুড়ে হাজারও কম্পিউটারে থাকে। যে কোনো লেনদেনে প্রত্যেকটি কম্পিউটারের ডেটা একসঙ্গে আপডেট হয়। একটি কনসেনসাস প্রটোকল রান করা হয়। প্রত্যেকটি ট্রান্সেকশনের হিস্ট্রি থাকে। অর্থাৎ টাকা কোথা থেকে কোথায় গিয়েছে, আবার কোত্থেকে এলো সব তথ্য সংরক্ষিত থাকে। ফলে কোনো একটি কম্পিউটার হ্যাক করে তথ্য পরিবর্তন করলে, অন্য সব কম্পিউটার কনসেনসাস প্রটোকল রান করে যখন মিল পাবে না, টেম্পারড কম্পিউটারের সব তথ্য মুছে দিয়ে অরিজিনাল তথ্য পুনরায় সেখানে রিপ্লেস করে দেবে। তাই ব্লকচেইন টেকনোলজির কোনো সিস্টেমকে হ্যাক করতে হলে একসঙ্গে সব কম্পিউটার হ্যাক করতে হবে, যা প্রায় অসম্ভব।
তাহলে ক্রিপ্টোমুদ্রার সমস্যা কোথায়
যে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি নিয়ে ক্রিপ্টোকারেন্সি উদ্ভাবিত হয়েছে সেটি ব্যবহারকারীদের ক্রমাগত এই মুদ্রায় বিনিয়োগ করতে আগ্রহী করছে; কিন্তু এ প্রযুক্তিকে পুরোপুরি উপযোগী হয়ে উঠতে আরো বহুমুখী সমস্যার সমাধান করতে হবে।
প্রথমত, ক্রিপ্টোকারেন্সির মূল্যমান স্থির নয়। মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য এমন মুদ্রা প্রয়োজন, যা দিয়ে নির্দিষ্ট পণ্য নির্দিষ্ট দামে কেনা যাবে, দাম বাড়লে বা কমলেও আন্দাজ করা যাবে, অস্বাভাবিক হবে না। এ সমস্যা সমাধানে কিছু ক্রিপ্টোমুদ্রা ট্র্যানজিবল অ্যাসেটের বিপরীতে নিজেদের মূল্যমান নির্ধারণ করে দিয়েছে। এমন মুদ্রাকে বলা হচ্ছে স্টেবল কয়েন।
দ্বিতীয়ত, ক্রিপ্টোকারেন্সিতে ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। ছদ্মনামের আইডি দিয়েও ক্রিপ্টোমুদ্রা লেনদেন করা যাচ্ছে। ছদ্মনাম ব্যবহার না করলেও, সঠিক নাম হলেও ক্রিপ্টোগ্রাফি প্রযুক্তির সুবাদে শুধু নিজের অ্যাকাউন্ট ছাড়া কারো পক্ষেই অন্যদের লেনদেন সম্পর্কে জানা সম্ভব নয়। ফলে ট্যাক্স বা অন্যান্য দায় ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। কালো টাকা নিরাপদে সংরক্ষণের জন্য ক্রিপ্টোমুদ্রা উপযোগী হয়ে উঠেছে।
বিভিন্ন অপরাধ সংঘটন এবং অপরাধমূলক অর্থ লেনদেন নীরবে নিভৃতে এবং আইনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে করার সুযোগ থাকছে ক্রিপ্টোমুদ্রায়। ক্রিপ্টোমুদ্রা আইনগতভাবে বৈধ হলে আইনের চোখ ফাঁকি দিতে প্রচলিত মুদ্রাকে ক্রিপ্টোমুদ্রায় রূপান্তরিত করে ফেলার সুযোগ তৈরি হবে। ক্রিপ্টোকারেন্সি বিষয়ে আইনবিজ্ঞান এখনো উল্লেখযোগ্যভাবে তৈরি হয়নি। স্বল্প কথায় বললে- কোনো রাষ্ট্র আইন করে ক্রিপ্টোকারেন্সিকে বৈধ বা অবৈধ ঘোষণা করেনি (দুই একটি ব্যতিক্রম রয়েছে)। অবৈধ ঘোষণা হয়নি ভিত্তিতে ক্রিপ্টোকারেন্সি বৈধ বেশির ভাগ রাষ্ট্রে।
ব্লকচেইন একটি যুগান্তকারী প্রযুক্তি হতে চলেছে। ক্রিপ্টোকারেন্সি (সম্ভবত যার জন্য ব্লকচেইন প্রযুক্তি সর্বাধিক পরিচিত) কেবল একটি ক্ষেত্র, যেখানে ব্লকচেইন প্রযুক্তির ব্যবহার এখনই লক্ষ্য করা যাচ্ছে; কিন্তু নিরাপদ তথ্য সংরক্ষণ, তথ্য যাচাইকরণ এবং তৃতীয় পক্ষের সত্যায়িতকরণ ছাড়াই নির্ভরযোগ্য তথ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব ব্লকচেইনের মাধ্যমে। এর ব্যবহার হতে পারে বহুবিধ। যেমন আমাদের ভূমি ব্যবস্থাপনার জটিলতার অন্যতম কারণ কিন্তু মালিকানা বিষয়ক তথ্য এবং ইতিহাস নির্ভরযোগ্যভাবে সংরক্ষণ করতে না পারা। ভূমি ব্যবস্থাপনায় ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করলে মালিকানা বিষয়ক অধিকাংশ জটিলতা সহজে সমাধান করা সম্ভব। তাই ব্লকচেইন প্রযুক্তির সঙ্গে ক্রিপ্টোমুদ্রাকে গুলিয়ে ফেলা যাবে না। মুদ্রা হিসেবে ব্লকচেইন প্রযুক্তি আদৌ সফল হতে পারবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা যেতেই পারে। কিন্তু, এর অন্যান্য প্রযুক্তিগত সম্ভাবনা মাথায় রেখে গবেষণা বাড়াতে হবে।
ক্রিপ্টোকারেন্সি অপার সম্ভাবনা এবং প্রতিশ্রুতি ধারণ করলেও নির্ভরযোগ্য মুদ্রাব্যবস্থা হয়ে উঠতে এটিকে আরো বিবিধ সমস্যার সমাধান করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা এ মুদ্রাব্যবস্থার অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করতে একে একটি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের অন্তর্ভুক্ত করা যায় কিনা, তা নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা করছেন। পুরোপুরি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যতীত একটি মুদ্রাব্যবস্থা চলতে পারবে না বলেই উল্লেখ করা যায়। কেননা রাষ্ট্রকে ট্যাক্সের ওপর নির্ভর করেই চলতে হয়। আবার ট্যাক্স ফাঁকি দিলে রাষ্ট্রের সামগ্রিক সেবাসমূহ পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তিকেও বিঘ্নিত হতে হবে। এছাড়া দুর্নীতি, কালোটাকা সংরক্ষণ, টাকাপাচার ইত্যাদি রোধ করতে হলেও কেন্দ্রীয় একটি নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংকের রক্ষণশীল অবস্থান সেই অর্থে যথার্থ। তবে বাংলাদেশের এ বিষয়ে পুরোপুরি উদাসীন হলেও চলবে না। যেহেতু ক্রিপ্টোকারেন্সি ও ব্লকচেইন প্রযুক্তি সামনের পৃথিবীতে পরবর্তী বিপ্লব আনার সম্ভাবনা রাখে, বাংলাদেশকে এ বিষয়ে গবেষণা, আলোচনা ও জ্ঞান বৃদ্ধিতে সজাগ থাকতে হবে।
লেখক :জাহিদ অয়ন, শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যে : আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)
প্রকাশিত লিঙ্কঃ ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা কোন কারণে