খাদ্যে ভেজাল : আইনগত ও স্বাস্থ্যগত দিক

‘খাঁটি জিনিস এই কথাটা রেখো না আর চিত্তে/ ভেজাল নামটা খাঁটি কেবল আর সবাই মিথ্যে।’ কালজয়ী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বলে গিয়েছিলেন এই উপমহাদেশের ব্যবসায়ীদের সার্বিক অবস্থা। একবিংশ শতাব্দীর মানুষের স্বাস্থ্যহানির অন্যতম দিক হচ্ছে ভেজাল মিশ্রিত খাদ্য গ্রহণ। জেনে শুনে কিংবা অজ্ঞতাবশত মানুষ এই খাদ্য গ্রহণ করছে, যা তার জীবন সংশয়ের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী অতি লাভের আশায় সমগ্র জাতির জীবনকে হুমকির মুখে ফেলছে, যা স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছে ও একই সাথে প্রাণনাশের আশঙ্কা বাড়াচ্ছে। আইনগত নানা বাধা ও স্বাস্থ্যের মারাত্মক ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও কেউ তা মানছে না বরং দিনদিন এই জঘন্য কার্যকলাপ বেড়েই চলেছে।

‘ভেজাল’ একটি আইনি শব্দ; যার অর্থ মিশ্রিত, মেকি বা খাঁটি নয় এমন। উৎকৃষ্ট দ্রবের সাথে নিকৃষ্ট দ্রব্যের মিশ্রণকে ভেজাল বলে। অন্যকথায়, খাদ্যের পরিমাণ, স্থায়িত্ব কিংবা স্বাদ বৃদ্ধির জন্য এক বা একাধিক পদার্থ সংযোগ। নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ অনুযায়ী, ‘বিভিন্ন উপায়ে খাদ্যে পরিবর্তন সাধন করে মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, আইনের অধীন নিষিদ্ধ, খাদ্যদ্রব্যের ক্ষতি হয়েছে, গুণাগুণ বা পুষ্টিমান কমে গেছে, খাদ্য ক্রেতার আর্থিক বা স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়েছে’ এমন খাদ্যই ভেজাল খাদ্য।

বাজার থেকে যেকোনো খাদ্যদ্রব্য কিনতে গেলেই আমরা আদৌ নিশ্চিত হতে পারি না এটা বিশুদ্ধ কিনা। অতি মুনাফা লাভের আশায় খাদ্যে রাসায়নিক দ্রব্যাদি, কীটনাশক, ডিডিটি, কাপড়ের রং, ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, যানবাহনে ব্যবহৃত তেল ও মোবাইল মিশ্রিত তেল, ইথেফেন প্রভৃতি বিষাক্ত ও ক্ষতিকর বস্তু হরহামেশাই খাদ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে, যা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

ভেজাল খাদ্য গ্রহণে গর্ভবতী নারীরা বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম দিতে পারে এবং গর্ভস্থ শিশু প্রতিবন্ধী হবে এর আশঙ্কা থাকে। দীর্ঘদিন ধরে ভেজাল খাদ্যগ্রহণে বয়স্ক ও শিশুদের মধ্যে আমাশয়, ডায়রিয়া, এপেন্ডিক্স, উচ্চ-রক্তচাপ, হৃদরোগ, রক্ত শূন্যতা, লিভার ও কিডনির ক্ষতি, ক্যান্সারসহ নানাধরনের শারীরিক বিপর্যয় দেখা যায়।

মূলত, সহজ প্রাপ্যতা, আইনি দুর্বলতা, যথাযথ নজরদারির অভাবে ভেজাল মিশ্রণের ঘটনা বেড়েই চলেছে, একইসাথে রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েই চলেছে।

জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা গবেষণাগারে পরীক্ষিত ৮২টি খাদ্যপণ্যের মধ্যে গড়ে ৪০ শতাংশ খাদ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন নির্ধারিত সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৩ থেকে ২০ গুণ বেশি নিষিদ্ধ ক্ষতিকর উপাদান পাওয়া গেছে। ৩৫ শতাংশ ফল ও ৫০ শতাংশ শাকসবজির নমুনাতেই কীটনাশকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এছাড়াও চালের ১৩টি নমুনায় মাত্রারিক্ত বিষক্রিয়া সম্পন্ন আর্সেনিক ও ক্রোমিয়াম, হলুদের গুঁড়ার ৩০টি নমুনায় সীসা এবং লবণে সহনীয়মাত্রার চেয়ে ২০-২৫ গুণ বেশি সীসা পাওয়া গেছে। এমনকি মাছ ও মুরগির মাংসে পাওয়া গেছে ক্ষতিকর এন্টিবায়োটিকের অস্তিত্ব। ঢাকা ও সাভার সংলগ্ন বিভিন্ন টেক্সটাইল, ডায়িং ও ট্যানারি থেকে নির্গত ক্ষতিকর বর্জ্য নদীর পানিতে মিশে যার ফলে শাকসবজি, মাছ ও কৃষি জমিতে লেড, আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, মার্কারিসহ নানাক্ষতিকর উপাদান মিলিত হয়ে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়। মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশে বিএসটিআই পরীক্ষিত ৪০৬টি নমুনার মধ্যে ৪৬টি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানের ৭৪টি পণ্যই নিম্নমানের পাওয়া যায়।

কিডনি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৬ ভাগ মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত এবং রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত খাদ্যগ্রহণই এর জন্য দায়ী। জাতীয় টাস্কফোর্স এনটিএফসির ভেজাল খাদ্যসামগ্রী প্রতি বছর বিভিন্ন প্রাণঘাতী রোগসহ ডায়রিয়া ও শিশুমৃত্যুর জন্য দায়ী। আইসিসিডিআরবি’র তথ্যমতে, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা তাদের এক সমীক্ষায় প্রমাণ পেয়েছে, প্রায় প্রতিদিন ৫০১ জন মানুষ ডায়রিয়াজনিত কারণে হাসপাতালে আসে, যার পেছনে ভেজাল খাবারই দায়ী। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ খাদ্যে বিষক্রিয়ার ফলে বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। একই সাথে আইনগত বলয়ের মাধ্যমে ভেজাল মিশ্রণকে অপরাধের পর্যায়ে ধরা হয়েছে।

(ক) সাংবিধানিক আইন : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন ১৯৭২-এর সংবিধানে জনগণের সুস্বাস্থ্য ও জীবনের অধিকারকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ১৫নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা হিসেবে অন্ন বা খাদ্যকে সর্বাধিকার দেয়া হয়েছে এবং অনুচ্ছেদ-১৮ অনুযায়ী জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতাকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে সরকার যেকোনো উদ্যোগ নিতে পারে এবং খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ ও তার আওতাভুক্ত। অন্যদিকে, বাধ্যবাধকতা তথা মৌলিক অধিকার হিসেবে অনুচ্ছেদ-৩২ উল্লেখ করা হয়েছে যেখানে জীবনের অধিকারকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রাখা হয়েছে। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার ও সুস্থ পরিবেশ নিরাপদ জীবনের পূর্বশর্ত। তাই বলা যায়, জনগণের জীবনের সুরক্ষা হিসেবে ভেজাল খাদ্য পরিহার কল্পে সংবিধান ও মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।

(খ) খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণে গৃহীত আইনসমূহ : খাদ্যে ভেজাল এমন একটি ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এই ভেজাল দমনে নানাবিধ আইন প্রণয়ন করেছে। ১৮৬০ সালের পেনাল কোডের ২৭২ ও ২৭৩নং ধারায় ভেজাল খাদ্য ও পানীয়কে নিষিদ্ধ করে এটিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধের আওতায় আনা হয়েছে। বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ ১৯৫৯, বিশুদ্ধ খাদ্য নীতিমালা ১৯৬৭, ভ্রাম্যমাণ আদালত অধ্যাদেশ ২০০৯, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯, নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩, বিএসটিআই আইন ২০০৩সহ অনেক আইন প্রচলিত রয়েছে।

১৮৬০ সালের দন্ডবিধির ২৭২ ধারায় খাদ্য ও পানীয়তে ভেজাল মেশানোর দায়ে কোনো ব্যক্তিকে অনধিক ৬ মাস পর্যন্ত কারাদন্ডের বিধান আছে এবং ২৭৩ ধারায় ক্ষতিকর খাদ্য ও পানীয় বিক্রয়ের অপরাধেও ৬ মাসের শাস্তির বিধান আছে। আবার ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন বলে ভেজাল মেশানোর সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ডের কথা উল্লেখ আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন বা ১৪ বছরের কারাদন্ডের কথা উল্লেখ আছে। জনগণের সুরক্ষায় প্রণীত ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের অধীনে ৭৬ (৪) অনুযায়ী, যেকোনো অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাৎক্ষণিকভাবে আদায়কৃত অর্থের ২৫% অভিযোগকারীকে প্রদান করা হবে। এ আইনের ৬৬ ধারা অনুযায়ী ভোক্তা চাইলে দেওয়ানি আদালতে মামলা করতে পারেন। আবার এ আইনের অধীন অপরাধগুলোর সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে ৩ বছর কারাদন্ড বা ২ লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয়দন্ড দেওয়ার বিধান আছে।

খাদ্যে ভেজাল রোধেও কঠোর ব্যবস্থা নিরূপণে নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ এর আওতায় ভেজাল খাদ্যসামগ্রী উৎপাদন, আমদানি, বিপণন পরিহার, তেজস্ক্রিয় ভারি ধাতুর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার রোধ, শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত তেল, বর্জ্য ভেজাল বা দূষণকারী দ্রব্য খাদ্য স্থাপনায় না রাখা, মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্য দ্রব্য বা খাদ্যোপকরণ না রাখা, খাদ্য মোড়কীকরণ ও লেবেলিং পরিবর্তন না করা, রোগাক্রান্ত বা পচা মাছ, মাংস, দুধ ইত্যাদি বিক্রয় না করা, হোটেল-রেস্তোরাঁর পরিবেশনকৃত খাবার দ্বারা স্বাস্থ্যের হানি না ঘটানো, নকল খাদ্য উৎপাদন, বিক্রয় পরিহার ইত্যাদি বিষয় আনা হয়েছে। এ আইনের ৬৪ ধারা অনুযায়ী ‘বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যেখানে একজন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বিচার করবেন। নিরাপদ খাদ্য আইনে ‘সামারি ট্রায়াল’ বা দ্রুত বিচারকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এখানে আদালত ন্যূন্যতম ৬ মাস থেকে সর্বোচ্চ ৫ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড এবং ন্যূনতম ১ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ পর্যন্ত অর্থদন্ড আরোপ করতে পারে। আইনের ৭৫ ধারা অনুযায়ী এ আইনের অধীন করা অপরাধের বিচারের জন্য মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯ এর অধীন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়াও খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ ও বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়, তবে এতে শাস্তির মেয়াদ কম।

খাদ্যে ভেজাল রোধে আমাদের করণীয় : অস্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ মানুষের জীবনকে এক মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে, যা প্রতিহত করা আমাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। নিরাপদ খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ, পুলিশ, মোবাইল কোর্ট প্রত্যেকের কড়া অনুশাসন সত্ত্বেও প্রতিনিয়ত তা বেড়েই চলেছে। আমাদের মধ্যে একটি প্রচলিত ধারণা রয়েছে- খাবার কিনে সেটা যাচাই না করে খাওয়া। খাদ্যের গুণাগুণ বিচার, ভেজাল থাকলে তা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানানো ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা একান্ত জরুরি। আমাদের সুষ্ঠু উদ্যোগ, সংবাদ মাধ্যম ও মিডিয়ার প্রচারণা ও যথাযথ আইনের প্রয়োগই পারে খাদ্যে ভেজালের মতো মারাত্মক অপরাধকে দেশ থেকে নির্মূল করতে। তবেই আমরা পাব- একটি সুস্থ, সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী জাতি।


লেখক : তামান্না-ই-নূর, শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত লিঙ্কঃ খাদ্যে ভেজাল : আইনগত ও স্বাস্থ্যগত দিক
সৌজন্যে : আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)