কর্মস্থল, এয়ারপোর্ট, বাসস্ট্যান্ড, রেলওয়ে স্টেশন, শপিংমলসহ জনসমাগম স্থলে এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত, পরিচালিত ও ব্যবস্থাপনায় বিধিবদ্ধ, স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। এ সংক্রান্ত জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে ২ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী ইবাদত হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ রায় দেয়।
বিগত ২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর নিরাপদে মায়ের বুকের দুধ পানের পরিবেশ চেয়ে হাইকোর্টে রিট করে ৯ মাস বয়সের ছোট্ট শিশু উমাইর বিন সাদী। সঙ্গে ছিল তার মা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান। প্রসঙ্গত, উমাইর মা-বাবার সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিল কক্সবাজারে। সমুদ্রসৈকতে বেড়ানো শেষে ঢাকায় ফেরার পথে কক্সবাজার বিমানবন্দরে উপস্থিত হয়। সেখানে অনিবার্য কারণে ফ্লাইট কয়েক ঘণ্টার বিলম্ব হয়। কিন্তু সেখানেই বিপদে পড়ে সে। প্রচুর ক্ষুধায় কান্না জুড়ে দেয়। শিশুটির কান্না থামাতে মা বুকের দুধ খাওয়ানোর উদ্যোগ নেন। কিন্তু তার মা এই শিশুটিকে দুধ খাওয়ানোর কোনো পরিবেশই পাচ্ছিলেন না। পরে ঢাকায় এসে শিশু উমাইরকে নিয়ে তার মা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান হাইকোর্টে এই রিট দায়ের করেন।
রিট আবেদনে কর্মক্ষেত্র, শপিংমল, এয়ারপোর্ট, বাসস্টপ, রেলওয়ে স্টেশনে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপনের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে, যেখানে কোনো মা সন্তানকে বুকের দুধ পান করাতে কোনো অস্বস্তি বোধ করবেন না বা যৌন হয়রানির শিকার হবেন না। সেটা কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে। রিটে এ সংক্রান্ত পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন সংযুক্ত করা হয়। নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি কর্মস্থলে ডে-কেয়ার সেন্টার ও মাতৃদুগ্ধদান কক্ষ স্থাপন করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এরপর ৯ বছর অতিবাহিত হলেও এক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো উন্নতি লক্ষ্য করা যায় নি। বেশির ভাগ কর্মক্ষেত্রে কর্মজীবী মায়েদের জন্য নেই ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার।
জনস্বার্থে করা এই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২৭ অক্টোবর হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল জারি করে। উক্ত রুলে আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বাস্থ্যসচিব, সমাজকল্যাণ সচিব, বিমান ও পর্যটন সচিবসহ সংশ্লিষ্ট ১৭ জন বিবাদীকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। রুলে কর্মস্থল, এয়ারপোর্ট, বাসস্ট্যান্ড, রেলওয়ে স্টেশন, শপিংমলের মতো জনসমাগম স্থলে এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত, পরিচালিত ও ব্যবস্থাপনায় বিধিবদ্ধ, স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্রেস্ট ফিডিং ও বেবি কেয়ার কর্নার প্রতিষ্ঠায় বিবাদীদের ব্যর্থতা কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। আইনজীবী আবদুল হালিম বলেন, সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে জীবনধারণের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। মায়ের দুধপান শিশুর মৌলিক অধিকার। দুধপানের অভাবে শিশু খর্বকায় হচ্ছে, এমন তথ্য আদালতে তুলে ধরা হয়। এ ছাড়া জনসমাগম স্থলে স্মোকিং জোন থাকলেও ব্রেস্ট ফিডিং ও বেবি কেয়ার কর্নার নেই, যা বৈষম্যমূলক। এই যুক্তিতে রিটটি করা হলে আদালত উক্ত রুল দেন।
পরবর্তী সময়ে বিগত ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোস্তাফিজুর রহমানের দ্বৈত বেঞ্চ সারা দেশের কলকারখানা ও মিলগুলোতে দুই মাসের মধ্যে ব্রেস্ট ফিডিং রুম স্থাপনের নির্দেশ দেয়। বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে ৯ মাস বয়সি কোনো শিশু এই প্রথম পিটিশনার হয়েছে। ছোট্ট শিশুর রিট পিটিশনার হতে আদালতের অনুমতিও নিতে হয়েছে। দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে প্রায় সাড়ে তিন বছর পর রিটের পূর্ণাঙ্গ শুনানি শেষে হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ এ যুগান্তকারী রায় ঘোষণা করে। এই রিটের ফলে দেশের সবগুলো বিমানবন্দর, রেল স্টেশনসহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ইতিমধ্যে ব্রেস্ট ফিডিং রুম স্থাপিত হয়েছে বলে আদালতে জানিয়েছে বিমান কর্তৃপক্ষ ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
রায়ের পর অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, আমি মনে করি, কর্মস্থল, বিমানবন্দর, রেল স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, শপিংমলসহ সকল জনবহুল স্থানে শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর নিরাপদ পরিবেশ সম্বলিত ব্রেস্ট ফিডিং রুম ও বেবি কেয়ার কর্নার স্থাপন সম্পন্ন হলে বাংলাদেশ সারা বিশ্বের জন্য একটা উদাহরণ সৃষ্টি করবে, যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য অনুসরণীয় হবে।
লেখকঃ নিশাত ছিদ্দিকা
প্রকাশিত লিঙ্কঃ প্রসঙ্গ :পাবলিক প্লেসে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপন