পারিবারিক আদালত কি শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য

সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ নানা ধর্মাবলম্বীর অনুসারী এ দেশে একত্রে বসবাস করে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭ অনুযায়ী আইনের দৃষ্টিতে সব নাগরিক সমান আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারী। দেশের অন্যান্য প্রচলিত আইনগুলো সব ধর্মের মানুষের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। তবে ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক আইনসমূহ ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের নিজ নিজ ধর্মীয় আইন অনুসারে প্রয়োগ হয়ে থাকে। যেমন—একজন মুসলমান ব্যক্তির স্থায়ী সম্পদ যে পদ্ধতিতে বণ্টন হয়, অনুরূপ পদ্ধতিতে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের সম্পদ বণ্টন করা হয় না। এক্ষেত্রে নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী ব্যক্তিগত আইন অনুসারে সম্পদ বণ্টন হয়ে থাকে। এছাড়াও রাষ্ট্রীয় বিধিবদ্ধ কিছু বিশেষ আইনের মাধ্যমেও বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। এ রকমই একটি বিশেষ আইন হলো পারিবারিক বিষয়-সম্পর্কিত পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫— এই আইনের ৫ ধারায় আইনটির এক্তিয়ার বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের বিধানাবলি সাপেক্ষে কোনো পারিবারিক আদালতের পাঁচটি বিষয়ের সব অথবা যে কোনোটির সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে মামলা গ্রহণ, বিচার এবং নিষ্পত্তি করার একক এক্তিয়ার থাকবে। বিষয়গুলো হলো : (ক) বিবাহবিচ্ছেদ, (খ) দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার, (গ) মোহরানা, (ঘ) ভরণপোষণ ও (ঙ) সন্তান-সন্ততিগণের অভিভাবকত্ব ও তত্ত্বাবধান।

যেহেতু এ আইনের এক্তিয়ারের প্রশ্নে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১-এর বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে, ফলে জনমনে প্রশ্ন আসতে পারে পারিবারিক আদালত কি শুধু মুসলমানদের জন্য? অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ কি এ আইনের মাধ্যমে প্রতিকার পেতে পারে না? মহামান্য আদালত বিভিন্ন মামলার প্রদত্ত রায়ে এসব প্রশ্নের সমাধান প্রদান করেছে।

নির্মল কান্তি দাস বনাম শ্রীমতী বিভা রানী—মামলায় আদালত এ মর্মে মতপ্রকাশ করে যে, পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশের আওতায় একজন হিন্দু মহিলাকে তার স্বামীর বিরুদ্ধে ভরণপোষণের মামলা করতে বিরত রাখবে না অর্থাত্ আদালতের এ বক্তব্য থেকে এটি স্পষ্ট যে, একজন হিন্দু নারী এ অধ্যাদেশের অধীন পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবে। মেহের নিগার বনাম মো. মুজিবুর রহমান—মামলায় আদালত বলে, পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ শুধু মুসলমানদের জন্য নয় বরং বাংলাদেশে বসবাসকারী অন্যান্য সম্প্রদায়ের জন্যও প্রযোজ্য হবে। একইভাবে পচন ঋষি দাস বনাম খুকু রানী দাস এবং অন্যান্য— মামলায় রায়ে বলা হয়েছে পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশের আওতায় শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে কোনো ব্যক্তির অধিকারকে খর্ব করবে না। অর্থাত্ সব ধর্মাবলম্বী মানুষ পারিবারিক আদালতে প্রতিকার লাভ করতে পারে। মূলত উল্লিখিত রায়ের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ সব সম্প্রদায়ের জন্য প্রযোজ্য। শুধু ধর্মের কারণে এ আইন প্রয়োগে কোনো বাধা নেই, দেশের সব নাগরিক সে মুসলিম হোক বা হিন্দু এ আইন থেকে প্রতিকার লাভের অধিকারী। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, একজন মুসলিম নারী বা পুরুষ এ আইনের এক্তিয়ারাধীন সব বিষয়ে প্রতিকার লাভ করতে পারলেও অন্য ধর্মের নারী বা পুরুষ শুধু তাদের ব্যক্তিগত আইনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে প্রতিকার লাভ করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ একজন হিন্দু নারী ভরণপোষণ ও সন্তান-সন্ততিগণের অভিভাবকত্ব ও তত্ত্বাবধান বিষয়ে মামলা করতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশে প্রচলিত হিন্দু আইনে বিয়ে বিচ্ছেদের বা দেনমোহরের কোনো বিধান না থাকায়, মুসলিম নারী ব্যতীত অন্যরা পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশের আলোকে বিবাহবিচ্ছেদ বা দেনমোহর বিষয়ে মামলা করতে পারবেন না। আমরা জানি, হিন্দু নারীদের ভরণপোষণ-সম্পর্কিত The Hindu Married Women’s Right to Separate Residence and Maintenance Act, ১৯৪৬ নামে একটি স্বতন্ত্র আইন আছে। তবুও দেখা যাচ্ছে যে, পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ দ্বারাই হিন্দুধর্মাবলম্বী প্রতিকার পেতে পারে এবং জীবন শর্মা বনাম শ্রীমতী সুবাসিনী শর্মা এবং অন্যান্য—মামলায় আমরা তার প্রতিফলন দেখতে পাই। এ মামলায় সর্বোচ্চ আদালত বাদীকে ভরণপোষণ প্রদানের নির্দেশ প্রদান করে। উল্লিখিত মামলাসমূহের রায় বিশ্লেষণে এটি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায় যে, এ দেশে বসবাসকারী প্রতিটি নাগরিক রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী গঠিত পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে প্রতিকার পাওয়ার অধিকারী।

 


লেখকঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ্ আল-গালিব, আইনজীবী
প্রকাশিত লিঙ্কঃ পারিবারিক আদালত কি শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য