গত ৩০ এপ্রিল ২০২৩ রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আগারগাঁও থেকে উত্তরা উত্তর স্টেশনে যাওয়ার পথে মেট্রোরেলের জানালায় ঢিল ছুড়ে মারার ঘটনা ঘটে। এতে কেউ হতাহত না হলেও জানালার কাচ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এতে মেট্রোরেলের প্রায় ১০ লাখ টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানায় কর্তৃপক্ষ। এরপরে মেট্রোরেল আইন, ২০১৫-এর ৩৫ ও ৪৩ ধারাসহ দণ্ডবিধি ৪২৭ ধারায় রাজধানীর কাফরুল থানায় এই আইনের অধীনে প্রথম মামলা দায়ের করা হয়। এর পর থেকেই মেট্রোরেল আইনটি বেশ আলোচনায় আসে।
২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর উদ্বোধনের মাধ্যমে ঢাকায় মেট্রোরেল আংশিক চালু হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, মেট্রোরেল প্রকল্পটি প্রতি বছর ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করবে, যা জাতীয় জিডিপির ১ দশমিক ৫ শতাংশের সমান। তাছাড়া মেট্রোরেল ঢাকার ১৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের জন্য যাতায়াত সহজ করে দেবে এবং এটি দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় আনবে গতিশীলতা, যা অর্থনীতিতে একটি বড় ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। ২০১৬ সালে এর নির্মাণকাজ শুরুর আগেই ঢাকা শহরের মেট্রোরেলের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার জন্য মেট্রোরেল আইন, ২০১৫ প্রণীত হয়। মেট্রোরেল আইন, ২০১৫-তে মেট্রোরেল ব্যবহারসংক্রান্ত বিভিন্ন অপরাধ, যেমন-বিনা ভাড়ায় মেট্রোরেল ভ্রমণ, টিকেট বা পাস জালিয়াতি, মেট্রোরেল পরিদর্শকদের বাধা, অনুপ্রবেশ এবং যাত্রীদের নিরাপত্তাহানি ইত্যাদি বিষয়ের আলোচনা ও শাস্তির উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া আইনটিতে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ, যাত্রীদের জন্য বীমা পদ্ধতি এবং জরিমানার কথাও বলা আছে।
কী আছে মেট্রোরেল আইনে
এই আইনের ৪০ ধারায় ভাড়া ফাঁকি দেয়াসম্পর্কিত শাস্তির বিধান রয়েছে। বৈধ টিকেট বা পাস ছাড়া ভ্রমণকারীদের মেট্রোরেলের যাতায়াতের ভাড়ার ১০ (দশ) গুণ পর্যন্ত অর্থদণ্ড দণ্ডনীয় এবং ওই অর্থদণ্ড অনাদায়ের ক্ষেত্রে অনধিক ৬ (ছয়) মাস কারাদণ্ড দণ্ডনীয় হতে পারেন। ৪৪ ধারায় বলা আছে, যেসব অপরাধী অপরাধের পুনরাবৃত্তি করবেন তাদের দ্বিগুণ জরিমানার সম্মুখীন হতে হবে। একইভাবে মেট্রোরেলের টিকেট বা পাস জালিয়াতিকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কোনো ব্যক্তি এই অপরাধ করলে অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন ধারা ৩৬ অনুযায়ী। ট্রেন বা স্টেশন চত্বরের সীমাবদ্ধ এলাকায় অনুপ্রবেশ একটি দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এর জন্য সম্ভাব্য এক বছরের জেল, ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয়ই হতে পারে।
মেট্রোরেলের যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছিল এই আইনের আরেকটি মূল বিষয়। মেট্রোরেল আইনের ৩৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি মেট্রোরেল ও উহার যাত্রীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় বা বিঘ্নিত হইবার সম্ভাবনা থাকে এইরূপ কোনো কর্মকাণ্ড সম্পাদন করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির উক্ত কার্য হইবে একটি অপরাধ, এবং তজ্জন্য তিনি অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ (পঞ্চাশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।’ আর ৪৩ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেন বা উক্ত অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা দেন বা ষড়যন্ত্র করেন এবং উক্ত ষড়যন্ত্র বা প্ররোচনার ফলে সংশ্লিষ্ট অপরাধটি সংঘটিত হয়, তাহা হইলে উক্ত সহায়তাকারী, ষড়যন্ত্রকারী বা প্ররোচনাদানকারী উক্ত অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।’
ক্ষতিপূরণের বিধান এই আইনটির আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক। এর জন্য মেট্রোরেল পরিচালনাকারী সংস্থাকে যাত্রী এবং ট্রেনের জন্য বীমা পলিসি নিতে হবে। দুর্ঘটনার পর মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ ক্ষতিপূরণ দাবি উত্থাপন এবং ৯০ দিনের মধ্যে বীমা কোম্পানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ সংগ্রহ করে ক্ষতিগ্রস্ত বা তাদের পরিবারকে দেয়ার জন্য দায়ী থাকবে মেট্রোরেল আইনের অষ্টম অধ্যায়ের অধীনে। উল্লেখ্য, মেট্রোরেল দুর্ঘটনার কারণে ট্রেন বা যাত্রী ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি বা স্থাপনা ও সম্পদের ক্ষতি হলে, সেজন্যও ক্ষতিপূরণ আদায় করে দেবে মেট্রোরেল পরিচালনাকারী কোম্পানি।
আইনের পর্যালোচনা
মেট্রোরেল আইনটির প্রধান উদ্দেশ্য মেট্রোরেলের নির্মাণ ও চলাচলের সুশৃঙ্খলা বজায় রাখা। তাছাড়া ২০১৫ সালের এই আইনে বাংলাদেশে মেট্রোরেল ব্যবস্থার জন্য একটি আইনি কাঠামো তৈরি হলেও, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতার অভাব পরিলক্ষিত হয়, যা এখনো পরিমার্জন করার সুযোগ রয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ‘দিল্লি মেট্রো রেলওয়ে (অপারেশন অ্যান্ড মেইন্টেইনেন্স) আইন, ২০০২’-এ ভাড়া ফাঁকি বা অনুপ্রবেশের মতো অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ৫০০ রুপি পর্যন্ত জরিমানার বিধান আছে। সেই অনুপাত ঢাকা মেট্রোরেল আইনের দ্বারা এই ক্ষেত্রে আরোপিত শাস্তির মাত্রা অনেক বেশি। অপরাধের প্রকৃতির তুলনায় জরিমানা এবং কারাগারের শর্তগুলো অতিরিক্ত। এই ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কতটা যুক্তিযুক্ত এবং অপরাধ হ্রাসে আসলে কতখানি কার্যকর তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। তাছাড়া ভাড়া ফাঁকি এবং অন্য সমস্যাগুলোর সম্ভাবনা হ্রাস করার জন্য মেট্রোরেলের সেবা আরো সুলভ হওয়া দরকার।
ক্ষতিপূরণের বিধানে মেট্রোরেল পরিচালনাকারী সংস্থাকে যাত্রী এবং ট্রেনের জন্য বীমা পদ্ধতি ব্যবস্থার কথা বলা আছে। যদিও এটি দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করার জন্য একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, কিন্তু এখানে বীমাসম্পর্কিত নির্দিষ্ট বিবরণ অন্তর্ভুক্ত করা নেই। যেমন ন্যূনতম ক্ষতিপূরণের পরিমাণ কত হবে বা দায় নির্ধারণে কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে ইত্যাদি সম্পর্কে আরো বিস্তারিত আলোচনার দরকার আছে। আইনটি বীমাকে বাধ্যতামূলক করেছে ঠিকই, কিন্তু এটিতে ন্যূনতম বীমা সুবিধা পাবার শর্তগুলো নির্দিষ্ট করা প্রয়োজন, যেন এর ক্ষতিপূরণ পাবার প্রক্রিয়াটি দ্রুতগতির হয়। ক্ষতিপূরণের দাবি বিবেচনা এবং বীমা বিষয়গুলো তত্ত্বাবধান করার ক্ষেত্রে একটি তৎপর কর্তৃপক্ষ বা কাঠামো প্রয়োজন হবে, যাতে কাজটা দক্ষতা এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে করা সম্ভব হয়। উল্লেখ্য, ভারতের দিল্লি মেট্রো রেলওয়ে (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেইনেন্স) আইনে এসব বিষয় তদারকির জন্য ক্লেইম কমিশনার নিয়োগের বিধান রেখেছে।
নিয়মিত নিরাপত্তা পরিদর্শন, রক্ষণাবেক্ষণের মান এবং অতিরিক্ত ভিড় মোকাবিলা এবং যাত্রীদের নিরাপত্তারক্ষায় করণীয় পদক্ষেপগুলো এই আইনটিতে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। মেট্রোরেল আইনে অপরাধ এবং সংশ্লিষ্ট শাস্তির সংজ্ঞায় স্পষ্টতার অভাব রয়েছে। এটি আইনটির আরেকটি অপূর্ণতা।
আইনটির ধারা ২০-এ মেট্রোরেলের প্রতিটি কোচে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী, মহিলা, শিশু ও প্রবীণদের জন্য নির্ধারিতসংখ্যক আসন সংরক্ষিত রাখার উল্লেখ রয়েছে। পাশাপাশি মেট্রোরেল ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবাই যেন সমান সুযোগ পায় এবং কোনো প্রকার বৈষমের শিকার যেন না হয়, তা নিশ্চিত করা জরুরি। আইনটিকে আরো জনবান্ধব করার জন্য মেট্রোরেল ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াগুলোতে জনগণের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে হবে।
বাংলাদেশের মেট্রোরেল প্রকল্প একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ, যা দেশের পরিবহন ব্যবস্থাকে একটি নতুন মোড় দিতে চলেছে। এক্ষেত্রে ২০১৫ সালের মেট্রোরেল আইনটি একটি সুশৃঙ্খল, নিরাপদ, এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক মেট্রোরেল ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তাই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা, স্পষ্ট সংজ্ঞা, অপরাধের আনুপাতিক শাস্তি, সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য বিধান, শক্তিশালী জনসম্পৃক্ততা, বীমা পদ্ধতি এবং দায় নির্ধারণের বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা দেয়ার মাধ্যমে আইনটিকে আরো পরিপূর্ণ ও শক্তিশালী করে তোলা দরকার।
[লেখক: তাহেফা সামিন, শিক্ষানবীশ আইনজীবী]
সৌজন্যে: আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)