আর্থিক খরচ, শারীরিক ও মানসিক ভোগান্তি, আছে প্রাণনাশের শঙ্কা। তাহলে এত সব ঝামেলা উপেক্ষা করে কেন আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসবেন সাক্ষীরা? অথচ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় যে কোনো বিচার ব্যবস্থায় সাক্ষীরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কারণ কোনো মামলা নিষ্পত্তির অন্যতম মূল উপকরণ হচ্ছে সাক্ষ্য। তাই তো ইংরেজ দার্শনিক ও আইনতত্ত্ববিদ জেরেমি বেন্থাম বলে গিয়েছেন- ‘উইটনেসেস আর দ্য আইজ অ্যান্ড ইয়ারস অব জাস্টিস’। সাক্ষীর সহযোগিতা এবং সত্যনিষ্ঠ সাক্ষ্য ছাড়া ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করা দিবাস্বপ্নের মতো। এ কারণে যে কোনো আইনি ব্যবস্থায় সাক্ষীদের সুরক্ষা দেয়া হচ্ছে ন্যায়বিচার প্রদানের অন্যতম শর্ত; কিন্তু বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনি কাঠামোতে যা এখন অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে অপরাধীকে দোষী সাব্যস্ত করার সংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তলানির দিকে। যার অর্থ হচ্ছে এ দেশে বেশির ভাগ মামলারই বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় না। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে মামলায় সাক্ষীর অনুপস্থিতি। আইনে তাদের জন্য কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকায় তারা আদালতে সাক্ষ্য দেয়া থেকে নিজেদের বিরত রাখে। অনেক সময় সমন ও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হলেও সাক্ষীদের আদালতে হাজির করা যায় না। এর ফলে অধিকাংশ মামলাই ফাইলবন্দী হয়ে পড়ে থাকে আর অপরাধীরা আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিব্যি সমাজে ঘুরে বেড়ায়। তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ সম্ভব হতো, যদি কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের নিরাপত্তা প্রদান করা হতো। অথচ স্বাধীনতার ৫১ বছর পেরিয়ে গেলেও তাদের সুরক্ষার জন্য করা হয়নি সুনির্দিষ্ট কোনো আইনি কাঠামো।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০ বছরে দায়ের করা ২৩ হাজার ৫৩৫টি মাদক মামলার আসামিকে খালাস দেয়া হয়েছে। তারা এর কারণ হিসেবে সাক্ষী হাজির না করতে পারার ব্যর্থতাকেই দায়ী করেছে।
গত ১১ জানুযারি ২০২২ তারিখে ঢাকা ট্রিবিউনে প্রকাশিত হওয়া একটি খবরের মাধ্যমে আমরা সাক্ষী সুরক্ষা আইনের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারি। যেখানে মিসেস লাইলা বেগম নামের একজন মহিলার শেষ পরিণতি ছিল ভয়াবহ। আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার জেরে তাকে বরণ করতে হয়েছে নির্মম মৃত্যু। জেল থেকে জামিনে বের হয়েই আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার প্রতিশোধ হিসেবে তাকে খুন করে ওই অভিযুক্ত আসামি। এ ঘটনার মাধ্যমে সাক্ষীদের নিরাপত্তার বর্তমান চিত্রের প্রতিচ্ছবিই ফুটে ওঠে।
সাক্ষীর নিরাপত্তা-সংক্রান্ত আইন
কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে অপরাধী ও তাদের সহযোগীরা হুমকি, ভয়ভীতি ও চাপ প্রয়োগ করে সাক্ষীকে বাধাদানের অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকে, যা সরাসরি দেশের সংবিধানের ৩১ এবং ৩২ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন। সংবিধানে ‘আইনের সুরক্ষার অধিকার’ এবং ‘জীবনের অধিকার এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সুরক্ষা’ উল্লেখ করা হয়েছে। এ সমস্ত কাজ আমাদের দেশে ঘটেই চলছে, অথচ আমাদের এখনো একটি নির্দিষ্ট সাক্ষী সুরক্ষা আইন নেই।
আমাদের সাক্ষ্য আইন, ১৯৭২-এর ধারা ১৫১ এবং ১৫২-এর মতো কিছু বিধান রয়েছে, কিন্তু এগুলো কেবল আদালতের ভিতরে সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য প্রযোজ্য। বাংলাদেশে দন্ডবিধি ১৮৬০-এর ৫০৩ ধারায় অপরাধমূলক ভীতি প্রদর্শনের জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২-এর ১৪ ধারায় সাক্ষীদের হুমকি দেয়ার ক্ষেত্রে শাস্তির বিধান রয়েছে। আবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন, ১৯৭৩-এর বিধি ৫৮(ক)(১)-তে সাক্ষীদের সুরক্ষা সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়া আছে; কিন্তু নেই আলাদা কোনো সাক্ষী সুরক্ষা আইন। তাই একটি নির্দিষ্ট আইনি এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অনুপস্থিতিতে, সাক্ষীদের সুরক্ষা এখনো অধরাই রয়ে গেছে।
সাক্ষী সুরক্ষায় হাইকোর্টের ভূমিকা
২০১০ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ‘বিএনডব্লিউএলএ বনাম বাংলাদেশ সরকার’ মামলায় যুগান্তকারী একটি নির্দেশনা দেয় যে, সরকার সাক্ষীদের পাশাপাশি যৌন হয়রানি প্রতিরোধে এগিয়ে আসা ব্যক্তিদের কার্যকর সুরক্ষার জন্য অবিলম্বে আইন প্রণয়নের পদক্ষেপ নেবে; কিন্তু এর বাস্তব প্রতিফলন শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। নেই কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ।
এরপর ২০১৫ সালে একটি হাইকোর্ট বিভাগের বেঞ্চ সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়নের নির্দেশ দিয়ে একটি আদেশ দেয়। তদুপরি আগস্ট ২০১৭ সালে ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের যৌথ প্রচেষ্টায়, অধস্তন আদালত এবং ট্রাইব্যুনালের জন্য সাক্ষী ব্যবস্থাপনা নীতি ২০১৭ খসড়া করা হয় এবং সম্প্রতি হাইকোর্ট বিভাগ কয়েকটি মামলা দ্রুত বিচারের জন্য কিছু নির্দেশিকা দিয়েছে। বিশেষ করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের মামলায় আদালতে সাক্ষীর উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য মনিটরিং সেল ও মনিটরিং কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছে। সঙ্গে সাক্ষীদের সুরক্ষার বিষয়ে আইন প্রণয়নের জন্য যথাযথ উদ্যোগ নেয়ার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে; কিন্তু এ সমস্ত পদক্ষেপ ওখানেই থেমে আছে। এখন পর্যন্ত কোনো সাক্ষী সুরক্ষা আইন বা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়নি।
বাংলাদেশে সংঘটিত অপরাধসমূহ পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, অনেক ক্ষেত্রেই অভিযুক্তরা অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে অনেক শক্তিশালী হয়ে থাকে। এদের পেছনে প্রভাবশালী মহলের মদদ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় তারা আরো অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। ফলে তারা অসংখ্য খুন, ধর্ষণ, যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটালেও সেই তুলনায় মামলা দায়ের হয় না। কারণ হুমকি, হয়রানি এবং মিথ্যা মামলার ভয়ে অনিরাপদ বোধ করায় অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পিছ-পা হয়ে যায় ভুক্তভোগীরা। যদিও কোনোভাবে মামলা আদালতে গড়ায়, তখন সাক্ষীরা অভিযুক্ত পক্ষের হুমকির শিকার হয়, এমনকি তাদের সাক্ষ্য দিতে আদালত বা ট্রাইব্যুনালে আসতে বাধাও দেয়া হয়। ফলে যথাযথ সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে অনেক গুরুতর মামলার অভিযোগ প্রমাণ করা সম্ভব হয় না। বিচার কার্যক্রম হয়ে পড়ে স্থবির। আর এজন্য অপরাধও প্রমাণ করা সম্ভব হয় না। এমনকি অনেক মামলায় অভিযুক্ত খালাসও পেয়ে যায়। এতে দেশে বাড়ে অপরাধ করার প্রবণতা।
এ সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় একটি যুগোপযোগী সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন এবং এর সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা। যাতে এর সুরক্ষা ব্যবস্থার প্রতি আশ্বস্ত হয়ে সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে উৎসাহিত বোধ করে। সুরক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর জোর দেয়া অত্যন্ত জরুরি। সাক্ষীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা প্রদান, আদালতে প্রবেশ নিশ্চিতকরণ, আর্থিক ক্ষতিপূরণ, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ আবাসন এবং নতুন পরিচয় প্রদান করা ইত্যাদি বিষয় মাথায় রেখে একটি আদর্শ আইন প্রণয়ন করা উচিত। তবে বাংলাদেশে সাক্ষী সুরক্ষা আইন বা এর বাস্তবায়নে বেশকিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। বিচার ব্যবস্থার ধীরগতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, ন্যায়বিচারের অনিশ্চয়তা এসবের মধ্যে অন্যতম, যা মোকাবিলা করতে আইনের পাশাপাশি দরকার শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ বিশ্বের অনেক দেশেই সাক্ষীর সুরক্ষায় আইন রয়েছে। সাক্ষীরা একটি মামলার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সাক্ষীকে সুরক্ষা দেয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য। রাষ্ট্র যদি সাক্ষীকে নিরাপত্তা দিতে না পারে, তাহলে মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতেই থাকবে। আর অপরাধীরা এ সুযোগ নিয়ে তাদের অপরাধমূলক কর্মকান্ড চালিয়েই যাবে; কিন্তু আমাদের দেশে এ বিষয়টি সব সময়ই উপেক্ষিত থেকে গেছে। তাই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে অনতিবিলম্বে বাংলাদেশে সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়নের কোনো বিকল্প নেই। কারণ আইন তৈরি হলে বাধ্যবাধকতাও তৈরি হবে। তখন সাক্ষীরা নির্বিঘ্নে আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে তাদের পবিত্র দায়িত্ব পালন করতে পারবে। একটি যুগোপযোগী আইন এবং এর বাস্তবায়নই পারে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে অপরাধ ও সহিংসতা কমাতে। তদুপরি পারে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে।
লেখক: জুয়েল কবির, প্রাবন্ধিক
প্রকাশিত লিঙ্ক: সাক্ষী সুরক্ষা আইন আর কতদূর
সৌজন্যে : আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)