মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) ছয় মাসের মানবাধিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন– এই ছয় মাসে দেশে ১১৯ সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, হুমকি, মামলা ও পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। ১০টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা, বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল ও তাদের নিজস্ব সূত্র থেকে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে মানবাধিকার পরিস্থিতির পরিসংখ্যানগত এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে আসক।
বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জামালপুর জেলা প্রতিনিধি এবং একাত্তর টিভির বকশীগঞ্জ উপজেলা সংবাদ সংগ্রাহক গোলাম রব্বানী নাদিমের ওপর হামলা ও মৃত্যুর প্রসঙ্গ তুলে ধরে আসক বলেছে, সাংবাদিকের ওপর এ ধরনের হামলা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। পেশাগত দায়িত্ব পালনে সাংবাদিকের মৃত্যুর ঘটনার প্রভাব অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী; জবাবদিহি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা সংকুচিত করে তোলে।
পাকিস্তান আমলে আমাদের এই দেশ পরাধীন ছিল। সে সময়ও আমাদের এত সাংবাদিক হামলা-মামলার শিকার হতে দেখিনি। অথচ ভাবতে অবাক লাগে, স্বাধীন বাংলাদেশে ছয় মাসে ১১৯ জন সাংবাদিক হামলা, মামলা, হত্যা, নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে পারে, আমাদের আইন করার সময় হয়তো এটা মাথায় রাখা হয় যে, আমরা ব্রিটিশ আমলে আছি! আমরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বা পাকিস্তানের অধীনে নেই; একটি স্বাধীন, গণতান্ত্রিক দেশের মানুষের জন্য এই আইন করা হচ্ছে– এটা মাথায় রাখা জরুরি।
আমরা বারবার বলছি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল হোক বা না হোক, অন্তত তদন্তের আগে কাউকে যেন গ্রেপ্তার না করা হয়। কেউ অপসাংবাদিকতা করে থাকলে তাঁর নামে মামলা হোক, তদন্ত হোক, তারপর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হোক। সাধারণত কোনো মামলার তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো ক্ষমতা একজন সাংবাদিকের নেই। তাহলে পেশাগত কাজের জন্য তাঁকে তদন্তের আগে গ্রেপ্তার করে রাখা হবে কেন? গ্রেপ্তার করার পর কারাগারে আটকে রাখার ফলে ওই সাংবাদিক ও তাঁর পরিবারকে যে বর্ণনাতীত কষ্ট ভোগ করতে হয়– তদন্তে অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলে তাঁকে জীবনের এই দিনগুলো কি ফেরত দেওয়া যাবে? অন্তত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক। আইনে সেই বিধান নেই। তার মানে, যে কাউকে মামলা দিয়ে আটকে রাখা যাবে। হেনস্তা করা যাবে। যেখানে সাংবাদিকতা আছে, সেখানে অপসাংবাদিকতাও থাকবে। কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর অভিযোগ থাকলে তা প্রেস কাউন্সিলের মাধ্যমে করা হোক। প্রেস কাউন্সিল জানাবে, এ অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হতে পারে কিনা।
সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে, হত্যা করা হচ্ছে। এটা হতো না, যদি প্রথম থেকেই সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ, হত্যার সুষ্ঠু বিচার যথাসময়ে করা যেত। সাংবাদিকদের ওপর হামলা বা হত্যার ঘটনা হুট করে হয় না। এগুলো পরিকল্পিত। হয়তো কারও স্বার্থের বিরুদ্ধে গেল কোনো সাংবাদিকের প্রতিবেদন, তখন কোনো ছুতায় তাঁকে শায়েস্তা করা হবে। এ ক্ষেত্রে হামলার সঙ্গে পরিকল্পিতভাবে মামলাও দেওয়া হয়।
যে কেউ কারও নামে মিথ্যা তথ্য ছড়াতে পারে, তাঁর ছবির সঙ্গে অন্য কারও ছবি জুড়ে দিয়ে হেয়প্রতিপন্ন করতে পারে। এ ক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দরকার আছে। তবে এ আইনের অপব্যবহার ভয়াবহ আকারে বেড়েছে। কিছু হলেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলা হয়। রাষ্ট্র কি এত নড়বড়ে হয়ে গেছে! সরকারের সমালোচনা তো কেউ করতেই পারেন। সরকারের সব কাজ সবার ভালো লাগবে না– এটাই স্বাভাবিক। এ সমালোচনা করাকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলার অবকাশ নেই।
সাংবাদিকদের ওপর এ হামলা, মামলার দুটি প্রধান কারণ হলো– এক. ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা, দুই. অন্যায়-অত্যাচারের কথা যেন জনগণের মধ্যে না পৌঁছায়। জনগণকে জানায় যে সাংবাদিক, তাকেই যদি কোণঠাসা করে ফেলা যায়, তাহলে তথ্যপ্রবাহ আটকে দেওয়া যায়। একজনকে শায়েস্তা করে অন্যদের হুমকি দেওয়া হয়, অন্য কেউ যেন এমন কিছু করতে না যায়। বর্তমান যুগ হলো তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। এখানে যার কাছে যত বেশি তথ্য আছে এবং যে যত বেশি তথ্য সরবরাহ করতে পারবে, সে তত শক্তিশালী। এ যুগে আমরা কাউকে এটা বলতে পারি না, আপনি এটা কেন লিখলেন, কেন বললেন, এ ছবি কেন তুললেন। একবার টার্গেটে পড়লে হামলা-মামলাসহ তাঁর জীবিকাও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। যে দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হয়, সেখানে গণতন্ত্র শক্তিশালী থাকতে পারে না।
জেড আই খান পান্না
চেয়ারপারসন, আসক
প্রকাশিত লিঙ্কঃ একজনকে শায়েস্তা করে অন্যদের হুমকি