দন্ডিতের মুক্তজীবন : প্রসঙ্গ প্রবেশন

আসামি সাক্ষ্যপ্রমাণ নিয়ে বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরও জেলখানায় যাবে না, বরং বাইরে ঘুরে বেড়াবে আদালতের স্বীকৃত অপরাধী এটা কীভাবে হয়! সমাজে তাহলে ন্যায়-অন্যায়, বিচার-আচার বলে কিছু থাকবে? প্রবেশন নিয়ে গত কিছুদিন আগেও এমনই মনোভাব ছিল দেশের আইন-আদালতের সঙ্গে সম্পর্কিত বেশির ভাগ মানুষের। আর সাধারণ মানুষের তো এমনটা জানা বা ভাবার অবকাশই নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রবেশন কী, এর মাহাত্ম্যই বা কোথায়? সনাতনী বিচারব্যবস্থায় আদালতে সাক্ষ্যপ্রমাণে কেউ যদি দোষী সাব্যস্ত হন, তবে দন্ডিতকে কারাগারে সোপর্দ বা জরিমানা করে দেওয়া হয়। যাতে তিনি একই ধরনের বা অন্য কোনো অপরাধে জড়িত হতে না পারেন এজন্য তাকে আটক রেখে অপরাধের পুনরাবৃত্তি করা থেকে যেমন নিবৃত্ত রাখা হয়, তেমনই ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তার অপরাধের প্রতিশোধস্বরূপ তাকে সমাজ-পরিবার সব থেকে বিচ্ছিন্ন রেখে তার শরীর ও মনের ওপর নানান শাস্তিমূলক ব্যবস্থা আরোপ করা হয়। তাকে সমাজের অপরাপর সম্ভাব্য অপরাধীর কাছে একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করার প্রয়াসও থাকে এই ব্যবস্থায়। কিন্তু আধুনিক বিচারব্যবস্থায় অপরাধীকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা আরোপের বদলে তার মুক্ত জীবন-জীবিকা অব্যাহত রেখে কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে রেখে নিজ ও জনহিতকর বিভিন্ন কাজ ও নিয়ম-শৃঙ্খলার ভেতর নিয়োজিত রেখে সংশোধনের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ও সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার ওপরই জোর দেওয়া হয়। এই ব্যবস্থাকেই সাধারণভাবে ‘প্রবেশন’ বলে চিহ্নিত করা যায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের বোস্টন শহর নিবাসী একজন মহানুভব জুতো প্রস্তুতকারী জন অগাস্টাসকে প্রবেশনের উদ্্গাতা বলে মান্য করা হয়। ১৮৪১ সালের এক দিন তিনি আদালতে দেখতে পেলেন যে, প্রকাশ্যে মাতলামির দায়ে দোষী সাব্যস্ত একজন অপরাধী বিচারকের কাছে হাতজোড় করে একটিবার সুযোগ দিলে তিনি নিজেকে শুধরে নেবেন এবং এজন্য প্রয়োজনে চিরতরে মদ্যপান ত্যাগ করবেন বলে প্রতিজ্ঞা করে তাকে জেলখানায় না পাঠিয়ে মুক্তি দিতে মিনতি করছেন। জন অগাস্টাস এটা দেখে এতটাই আপ্লুত হন যে, তিনি বিচারকের কাছে আবেদন করে দন্ডিতের জামানতের টাকা শোধ করে তাকে তিন সপ্তাহ সময়কাল পুনর্বাসনের জন্য নিজ হেফাজতে নেন। তিন সপ্তাহের মধ্যে জন ও আসামি উভয়ের আন্তরিক প্রচেষ্টায় এতটাই উন্নতি হয় যে, আদালতে উপস্থিত হওয়ার পর বিচারক দন্ডিতকে মুক্তি দেন। এই প্রাথমিক সাফল্যের পর জন অগাস্টাস নিয়মিতভাবে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের শোধরানোর জন্য নিজ হেফাজতে নিতে থাকেন। এভাবে ১৮৫৯ সালে তার মৃত্যুর আগে তিনি ২০০০-এরও বেশি মানুষকে পুনর্বাসনমূলক হেফাজতে নেন। তিনি স্বোপার্জিতসহ শুভানুধ্যায়ীদের দেওয়া অর্থ দিয়ে দন্ডিতদের জামানত শোধ করতেন। তার মৃত্যুর পর তার অনুসারীরাও এই ব্যবস্থা অব্যাহত রাখেন। ১৮৭৮ সালে এই ব্যবস্থাকে আইনি কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করে বোস্টনের আদালতগুলোতে স্থায়ী প্রবেশন কর্মকর্তার পদ সৃজন করা হয়। ১৮৯১ সালে তা পুরো অঙ্গরাজ্যে চালু করা হয়। ১৯০০ সালের মধ্যে এটা অন্যান্য রাজ্যেও চালু হয়। পরে ১৯২৫ সালে ফেডারেল আইন প্রণয়নের মাধ্যমে পুরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশন চালু হয়।

আমাদের দেশে প্রবেশনের বিধানও শতাব্দী প্রাচীন। ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধিতে সর্বপ্রথম প্রবেশনের ব্যবস্থা রাখা হয়। ৫৬২-৫৬৪ নম্বর ধারাগুলোতে প্রথমবারের মতো চুরি, তহবিল তছরুপ বা দন্ডবিধি, ১৮৬০ অনুযায়ী যেসব অপরাধের দন্ড অনধিক ২ বছর, সেসব ক্ষেত্রে দন্ডিতদের আদালত প্রবেশনে মুক্তি দিতে পারত। পরে এই ধারাগুলো রদ করে ১৯৬০ সালে দন্ডিতের প্রবেশন-সংক্রান্ত আইন (দি প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০) প্রণীত হয়ে ১৯৬২ সালে কার্যকর হয়। ১৯৭১ সালে এই আইনের অধীন বিধি প্রণীত হয়। এই আইন অনুসারে হাইকোর্ট বিভাগ, সব দায়রা ও প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট এবং প্রবেশন দিতে বিশেষভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলো প্রবেশন দিতে পারবেন। আর যেসব ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের এই ক্ষমতা নেই, সেসব আদালত প্রবেশন দেওয়া সমীচীন মনে করলে সংশ্লিষ্ট প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে প্রবেশন দেওয়া-সংক্রান্তে তাদের মতামতসহ মামলা পাঠিয়ে দেবেন। সেই আদালতই তখন এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। আপিল বা রিভিশন আদালতও প্রবেশন আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা আছে। আইন পুরনো হলেও এগুলোর প্রয়োগে বিচারব্যবস্থা, রাষ্ট্র বা বিচারপ্রার্থী জনগণ সবার মধ্যেই এক ধরনের শীতলতা বিরাজ করে এসেছে দীর্ঘদিন ধরে। কালেভদ্রে ব্যতিক্রম হিসেবেই কেবল এই আইনের প্রয়োগ হতো। ২০০৬ সালে দেশের বিচারব্যবস্থায় প্রবেশনের পুনরুজ্জীবনে পৌরোহিত্য করেন তৎকালীন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী (বর্তমানে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি)। তিনি আবদুল খালেক বনাম হাজেরা বেগম ও অন্যান্য (৫৮ ডিএলআর ৩২২) মামলার রায়ে দন্ডিতের প্রবেশন মঞ্জুর করেন এবং রায়ের অনুলিপি বিচারকদের কাছে প্রেরণের আদেশ দিয়ে বরফ গলানোর কাজটি করেন। হাইকোর্ট বিভাগ ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ তারিখের জে-০১/২০১৯ নম্বর সার্কুলার জারির মাধ্যমে অধস্তন আদালতগুলোকে প্রবেশন-সংক্রান্ত বিধানগুলো মেনে চলার তাগিদ দেয়। বিদ্যমান প্রবেশন আইনের ৫ ধারা অনুসারে আসামির স্বেচ্ছায় দোষ স্বীকার বা সাক্ষ্যপ্রমাণে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট বিচারক যদি স্বপ্রণোদিতভাবে মনে করেন যে, আসামিকে দন্ড দেওয়ার চেয়ে প্রবেশনে মুক্তি দেওয়া যুক্তিযুক্ত হবে, তখন তিনি দন্ড ঘোষণা স্থগিত রেখে নিয়োজিত প্রবেশন কর্মকর্তার কাছ থেকে আসামির স্বভাব-চরিত্র, পারিবারিক অবস্থা, বাসস্থান ইত্যাদি সম্পর্কে নির্ধারিত ই-ফর্মে প্রাক-দন্ডাদেশ প্রতিবেদন তলব করতে পারেন। এরপর বিচারক মুচলেকা প্রদান সাপেক্ষে দোষীকে ১-৩ বছরের জন্য একজন প্রবেশন কর্মকর্তার হেফাজতে মুক্তি দিতে পারেন। এ সময় আদালত দোষী ব্যক্তির ওপর বিভিন্ন শর্তারোপ করতে পারেন। প্রবেশন কর্মকর্তা এসব শর্ত প্রতিপালনের ব্যবস্থা করবেন এবং সময়ে সময়ে আদালতে অগ্রগতি প্রতিবেদন দেবেন। এ সময় দোষী ব্যক্তিটি সব শর্ত পালনের মাধ্যমে নিজেকে সংশোধিত করে নেওয়ার পর চূড়ান্ত প্রতিবেদন বিবেচনা করে আদালত পূর্ণ সন্তুষ্টিতে মামলাটি নিষ্পত্তি করে দোষী ও তার জামিনদারদের মুচলেকা থেকে অব্যাহতি দেবেন।

এই আইনের ৫ ধারার আওতায় দন্ডবিধি ১৮৬০-এ ঘোষিত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ও সশস্ত্র বাহিনী সম্পর্কিত অপরাধ (ধারা ১২১-১৪০), ডাকাত, দস্যুতা এবং গুরুতর ধরনের চুরি ও সিঁধকাটা, বিষপ্রয়োগ ইত্যাদি ধরনের অপরাধ (ধারা ২১৬ক, ৩২৮, ৩৮২, ৩৮৬, ৩৮৭, ৩৮৮, ৩৮৯, ৩৯২, ৩৯৩, ৩৯৭, ৩৯৮, ৩৯৯, ৪০১, ৪০২, ৪৫৫, ৪৫৮)-সহ যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও মৃত্যুদন্ডের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত পুরুষ প্রবেশনের জন্য উপযুক্ত হবেন না। বাকি সব আইনেরও যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও মৃত্যুদন্ডযোগ্য ছাড়া অপর সব অপরাধের জন্য পুরুষরা প্রবেশন পেতে পারেন। তবে, নারীদের ক্ষেত্রে শুধু মৃত্যুদন্ডের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত অপরাধী ছাড়া সবাই প্রবেশনে মুক্তি পাওয়ার জন্য বিবেচিত হবেন। অবশ্য অধিকারবলে কেউ প্রবেশন চাইতে পারেন না। এটা আদালতের একচ্ছত্র ও স্ববিবেচনাধীন ক্ষমতা এবং কেবল উপযুক্ত মনে করলেই আদালত কাউকে এই সুযোগ দিতে পারেন। এই আইনে শুধু দোষীদের জন্যই সুবিধা আছে এমন নয়। প্রবেশন আদেশ হলে ৬ ধারা অনুসারে আদালত অপরাধের শিকার ব্যক্তিকে সংশ্লিষ্ট অপরাধের জরিমানার সমান পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ দিতে পারবেন। আবার, দোষী ব্যক্তি প্রবেশনে মুক্তি পেলেই যে তিনি পগার পার হয়ে যাবেন এমন নয়। আইনের ৭ ধারা অনুসারে প্রবেশনের শর্ত ভঙ্গ করলে আদালত সমন/গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে প্রবেশনারকে আদালতে হাজির করে উভয় পক্ষকে বক্তব্য রাখার সুযোগ দিয়ে প্রবেশন বাতিল না করেই তাকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবে। এই অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে মূল অপরাধের শাস্তিও আরোপ করতে পারে। অথবা আদালত সরাসরি প্রবেশন আদেশ বাতিল করে তাকে মূল অপরাধের জন্য সাজা দিয়ে দিতে পারে।

দোষীকে আত্মশুদ্ধির সুযোগ দেওয়া ও সাহায্য করাই হচ্ছে প্রবেশনের উদ্দেশ্য। শিশুরাই হন প্রবেশনের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি। বর্তমানে প্রবেশনের মূল আইন ছাড়াও শিশু আইন, ২০১৩ অনুসারে শিশুদের (১৮ বছরের কম বয়স্ক) মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড যোগ্য অপরাধ ছাড়া অন্য অপরাধে ৩ বছর পর্যন্ত আটকাদেশ দিলে তাদের শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে আটক রাখার বদলে শিশু আদালত প্রবেশনে মুক্তি দিতে পারে। তা ছাড়া, কারাগারে আটক সাজাপ্রাপ্ত নারীদের বিশেষ সুবিধা আইন, ২০০৬-এর আওতায় কোনো নারী এক বছরের বেশি দন্ডিত হলে রেয়াতসহ দন্ডের অর্ধেক সময় পার হয়ে গেলে সরকার তাকে প্রবেশনে মুক্তি দিতে পারে। প্রবেশনের ক্ষেত্রে একটি বড় সুবিধা হলো এই আদেশ হলেও তা আইনত দন্ড হিসেবে গণ্য হবে না। ফলে, প্রবেশনারের পেশাগতসহ অন্য কোনো ক্ষেত্রেই তা তার অযোগ্যতা চিহ্নিত হবে না। অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া শিশুদের জন্য যা ভবিষ্যৎ জীবনের পাথেয়স্বরূপ হবে। গত ১৩ অক্টোবর তারিখে হবিগঞ্জের শিশু আদালতের বিজ্ঞ বিচারকের একসঙ্গে ৭০ জন শিশুকে দোষ স্বীকারের পর প্রবেশনে মুক্তি দেওয়াটা সারা দেশেই সাড়া তুলেছে। এই আদালত এর আগে অক্টোবর ২০২০-এ ১০টি মামলায় ১৪টি শিশুকে এবং জানুয়ারি ২০২১-এ ৩৫টি মামলায় ৪৯ শিশুকে প্রবেশনে মুক্তি দিয়েছিল। শর্তগুলোর মধ্যে হলো প্রতিদিন তাদের ২টি ভালো কাজ করতে হবে এবং এসব ভালো কাজের বর্ণনা তাদের আদালত থেকে যে ডায়েরি দেওয়া হবে তাতে লিখে রাখতে হবে; বাবা-মায়ের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে এবং তাদের যতটা সম্ভব সহায়তা করতে হবে; তাদের নিয়মিত কোরআন পাঠ করতে হবে এবং ধর্মীয় বিধিবিধান পালন করতে হবে; অসৎসঙ্গ থেকে দূরে থাকতে হবে; মাদককে ‘না’ বলতে হবে ও সব ধরনের অপরাধ থেকে দূরে থাকতে হবে। অবশ্য আদালতের আদেশের মাধ্যমে কাউকে ধর্ম পালন বা ধর্মীয় বিধিনিষেধ পালনে বাধ্য করা যায় কি না বা এ ধরনের আদেশ সংবিধানের ধর্মীয় স্বাধীনতার মতো মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় কি না এই বিবেচনায় বিকল্প কোনো শর্ত দেওয়া যেতে পারে কি না সেটা ভেবে দেখা যেতে পারে। অপরাধীদের নরকের কীট ভেবে তাদের সমাজ-সংসার থেকে দূরে ঠেলে দিয়ে কারাপ্রকোষ্ঠে অবরুদ্ধ করেই যে অপরাধ কমানো যায় না, তা দেশের কারাগারের সংখ্যা-আয়তন ও কারাবন্দিদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা থেকেই প্রতীয়মান হয়। এই কর্মধারাকে আরও বেগবান করে তুলতে হবে। এজন্য দেশের বিচার বিভাগকেই সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে।


লেখক: মিল্লাত হোসেন, প্রাবন্ধিক
দেশ রুপান্তর লিঙ্কঃ দন্ডিতের মুক্তজীবন : প্রসঙ্গ প্রবেশন