চট্টগ্রামে চলছে পাহাড় কাটা, উপেক্ষিত আদালতের নির্দেশ

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী চট্টগ্রাম। বাণিজ্যিক রাজধানী ও বন্দরনগরী নামে খ্যাত এ শহরটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। পাহাড়, সমুদ্র ও উপত্যকায় ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এ নগরী বর্তমানে প্রায় ২৫ লাখ মানুষের আবাসভূমি। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত এ নগরীতে রয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ বন্দর এবং দেশের প্রধান সামুদ্রিক প্রবেশ দ্বার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণা অনুযায়ী এক সময় এ নগরীতে ছোট বড় প্রায় ২০০টি পাহাড় ছিল। ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে ১২০টি। মাত্র ৩২ বছরে নগরীর ১৮ দশমিক ৩৪৪ বর্গকিলোমিটার পাহাড় নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে।

একই গবেষণা অনুযায়ী ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচটি থানা এলাকায় মোট পাহাড় ছিল ৩২ দশমিক ৩৭ বর্গকিলোমিটার। ২০০৮ সালে সেটা কমে দাঁড়ায় ১৪ দশমিক ২ বর্গকিলোমিটার। মাঝের ৩২ বছরে ১৮ দশমিক ৩৪৪ বর্গকিলোমিটার পাহাড় নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে, যা মোট পাহাড়ের প্রায় ৫৭ শতাংশ।

গবেষণায় দেখা গেছে, এসব পাহাড় কাটা হয়েছে নগরীর বায়েজিদ, খুলশী, পাঁচলাইশ, কোতোয়ালি ও পাহাড়তলী থানা এলাকায়। এই পাঁচটি এলাকায় ৮৮টি পাহাড় সম্পূর্ণ এবং ৯৫টি পাহাড় আংশিক কাটা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৭৪ শতাংশ পাহাড় কাটা হয়েছে পাঁচলাইশ এলাকায়।

বর্তমানে লালখান বাজার মতিঝর্ণা, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, ওয়ার সিমেট্রি, ফয়’স লেক, ষোলশহর, এমইএস কলেজ সংলগ্ন পাহাড়গুলো অনেকটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়েছে। দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী নগর উন্নয়নের নামে খোদ চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) প্রায় ২০টি পাহাড় কেটেছে ফৌজদারহাট-বায়েজিদ বাইপাস সড়ক নির্মাণ করতে গিয়ে। উল্লিখিত এলাকায় এখনও চলছে পাহাড় কাটার মহোৎসব। শহরের মুরাদপুর এলাকায় বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের চারটি পাহাড় কেটে নির্মাণ করা হচ্ছে বহুতল ভবন।

চট্টগ্রাম বিভাগের ৫টি জেলা যথাক্রমে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনসহ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলাসমূহে অবস্থিত সব পাহাড় কর্তন বন্ধে ২০১১ সালে একটি জনস্বার্থমূলক মামলা (মামলা নং ৭৬১৬/২০১১) দায়ের করে। মামলার চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিগত ১৯ মার্চ, ২০১২ তারিখে আদালত উল্লিখিত জেলাসমূহে অবস্থিত সকল পাহাড় কর্তন বন্ধে প্রয়োজনীয় ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করেন। একইসাথে আদালত উল্লেখিত এলাকায় পাহাড় কেটে কোনো আবাসন প্রকল্প বা ইটভাটা স্থাপন করা হয়ে থাকলে তা ভেঙে ফেলার নির্দেশ প্রদান করেন। সেই সাথে বন উজাড় বন্ধ করতে এবং পাহাড়ি অঞ্চলে প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যের অবিরাম প্রবাহ নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ প্রদান করেন।

বেলা কর্তৃক দায়েরকৃত অপর একটি জনস্বার্থমূলক মামলায় (৭৮৮৩/২০১৫) মহামান্য আদালত চট্টগ্রাম মহানগরীর আকবর শাহ থানার অধীন উত্তর পাহাড়তলী মৌজায় অবস্থিত পাহাড় কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞার আদেশ প্রদান করেন। আদালতের সুষ্পষ্ট আদেশ থাকা সত্ত্বেও চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন স্থানে পাহাড় কাটা অব্যাহত থাকলে বেলা পুনরায় পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে আদেশ চেয়ে হাইকোর্ট বিভাগে আবেদন করে। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩১ জানুয়ারি ২০২৩ চট্টগ্রাম বিভাগের (চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি এবং খাগড়াছড়ি জেলাসমূহ) সকল পাহাড়ের তালিকা (দাগ, খতিয়ানসহ) এবং পাহাড়সমূহের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রস্তুত করে তা আদালতে জমা প্রদানের জন্য বিবাদীগণকে নির্দেশ প্রদান করেন আদালত। একইসাথে আদালত ২০১২ সালের ১৯ মার্চে (রিট পিটিশন নং ৭৬১৬/২০১১) প্রদত্ত রায়ের আলোকে পাহাড় কাটা রোধে সরকারের সংস্থাগুলো কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, সে বিষয়ে আদালতে প্রতিবেদন প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন।

চট্টগ্রাম বিভাগের উল্লিখিত জেলাসমূহে সর্বশেষ বিদ্যমান পাহাড়গুলোকে আরো ক্ষতি, ধ্বংস ও কর্তন হতে রক্ষার জন্য সকল প্রয়োজনীয় ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং পাহাড় ও টিলায় পাহাড় কাটা বিষয়ে আদালতের যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তা প্রতিটি পাহাড়ে প্রদর্শন করার নির্দেশ প্রদান করেছেন আদালত। সেইসাথে ইতোমধ্যে কর্তন করা হয়েছে এমন পাহাড়গুলোতে দেশীয় প্রজাতির বৃক্ষরোপণ এবং দেয়াল দ্বারা সুরক্ষিত রাখার নির্দেশ প্রদান করেন আদালত। উল্লিখিত নির্দেশনাবলীর বাস্তবায়ন সাপেক্ষে আগামী তিন মাসের মধ্যে বিবাদীদের আদালতে প্রতিবেদন প্রদানের নির্দেশ প্রদান করেন আদালত।

সম্প্রতি কুমিল্লা জেলাধীন কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার লালমাই মৌজায় অমূল্য প্রত্নসম্পদে ভরা লালমাই পাহাড় রক্ষায় বেলা কর্তৃক দায়েরকৃত জনস্বার্থমূলক মামলার জনস্বার্থমূলক (নং-১৩৫০০/২০২২) এর প্রাথমিক শুনানি শেষে বিগত ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, হাসান টেকনো বিল্ডার্স লিমিটেড ও হক এন্টারপ্রাইজ জয়েন্ট ভেঞ্চার (জেভি) এবং ম্যাজিক প্যারাডাইস পার্ককে মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কুমিল্লার লালমাই পাহাড় কাটা ও অন্যান্য পাহাড় ধ্বংসমূলক কার্যক্রম থেকে বিরত রাখতে মহাপরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর; জেলা প্রশাসক, কুমিল্লা; পুলিশ সুপার, কুমিল্লা; পরিচালক (চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়), পরিবেশ অধিদপ্তর; ও উপপরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর, কুমিল্লাকে নির্দেশ প্রদান করেছেন মহামান্য হাইকোর্ট।

সেই সঙ্গে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, কুুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, হাসান টেকনো বিল্ডার্স লিমিটেড ও হক এন্টারপ্রাইজ জয়েন্ট ভেঞ্চার (জেভি) এবং ম্যাজিক প্যারাডাইস পার্ক কর্তৃপক্ষের কার্যক্রমের ফলে ইতোমধ্যে লালমাই পাহাড়ের প্রতিবেশ ব্যবস্থা, উদ্ভিদ, প্রাণী ও জীববৈচিত্র্যের যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে তা নিরূপণের নির্দেশ দিয়েছেন মহামান্য আদালত। উল্লেখিত নির্দেশনাবলীর বাস্তবায়ন সাপেক্ষে বিবাদীদের আদালতে প্রতিবেদন প্রদানের নির্দেশ প্রদান করেন আদালত।

অন্তর্বর্তীকালীন এ আদেশের পাশাপাশি আদালত লালমাই পাহাড় রক্ষায় বিবাদীগণের ব্যর্থতা কেন আইন বহির্ভূত ও জনস্বার্থের পরিপন্থি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে বিবাদীগণের ওপর রুল জারি করেন। সেই সঙ্গে ক্ষয়িত পাহাড় যথাযথ পুনরুদ্ধার ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫-এর ধারা-৫ (প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা), প্রত্নতাত্ত্বিক আইন-১৯৬৮ এর ধারা-১০ (প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন), বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন-২০১২ এর ধারা-২২ (বিশেষ জীববৈচিত্র্য এলাকা) এবং জীববৈচিত্র্য আইন-২০১৭ এর ধারা-৩২ (জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ ঐতিহ্যগত স্থান) এর অধীন বিশেষ সংরক্ষণের আওতায় এনে তা সংরক্ষণের নির্দেশ কেন প্রদান করা হবে না তাও জানতে চেয়েছেন মহামান্য আদালত। লালমাই পাহাড়, পাহাড়ের প্রতিবেশ ব্যবস্থা ও উদ্ভিদ-প্রাণী ধ্বংস করায় সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, হাসান টেকনো বিল্ডার্স লিমিটেড ও হক এন্টারপ্রাইজ জয়েন্ট ভেঞ্চার (জেভি) এবং ম্যাজিক প্যারাডাইস পার্ক কর্তৃপক্ষসমূহের নিকট হতে ক্ষতিপূরণ আদায়ের নির্দেশ কেন প্রদান করা হবে না তাও জানতে চেয়েছেন আদালত।

শুধুমাত্র আদালতের নির্দেশই নয়, রয়েছে পাহাড় কর্তনের বিরুদ্ধে আইনি বিধান। পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ধারা ৬(খ)-এ বলা হয়েছে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধাসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন ও/বা মোচন (পঁঃঃরহম ধহফ/ড়ৎ ৎধুরহম) করা যাইবে না। তবে শর্ত থাকে যে, অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে অধিদপ্তরের ছাড়পত্র গ্রহণক্রমে কোনো পাহাড় বা টিলা কর্তন বা মোচন করা যাইতে পারে। এ আইনের ধারা ১৫ অনুযায়ী পাহাড় কাটার প্রথম অপরাধের ক্ষেত্রে অনধিক ২ (দুই) বৎসর কারাদ- বা অনধিক ২ (দুই) লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয়দন্ড এবং পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে অন্যূন ২ (দুই) বৎসর, অনধিক ১০ (দশ) বৎসর কারাদন্ড বা অন্যূন ২ (দুই) লক্ষ টাকা, অনধিক ১০ (দশ) লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডের বিধান রয়েছে।

আদালতের নির্দেশ ও আইনের বিধানকে লঙ্ঘন করে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে চলছে পাহাড় কাটা। পাহাড় কাটার সাথে জড়িত প্রভাবশালী মহল শুধু পাহাড় কেটেই ক্ষান্ত থাকছে তা নয় বরং তাদের কাজে বাধা দিলে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়েরসহ নানাভাবে হয়রানি করছে তারা।

সম্প্রতি বেলার প্রধান নির্বাহীসহ পরিবেশবাদী একটি দল চট্টগ্রামের আকবর শাহ এলাকায় পাহাড় কাটা পরিদর্শনে গেলে তাদের গাড়ি আটকে দেওয়া হয় এবং গাড়িতে ইট-পাথর ছুড়তে থাকে অত্র এলাকার পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িত একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও তার সহযোগীরা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের অভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না আদালতের নির্দেশ। এভাবে নির্বিচারে পাহাড় কাটা চলতে থাকলে দেশ পাহাড়শূন্য হতে আর বেশি সময় লাগবে না। স্বল্প পরিসরে দেশব্যাপী বিদ্যমান পাহাড় চিহ্নিত করে বিশেষ সংরক্ষণের আওতায় এনে তা সংরক্ষণ করাই বর্তমান সময়ের দাবি।


লেখক :জাকিয়া সুলতানা, আইনজীবী
প্রকাশিত লিঙ্কঃ চট্টগ্রামে চলছে পাহাড় কাটা, উপেক্ষিত আদালতের নির্দেশ
সৌজন্যে : আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)