ফিরোজকে গুলির দায়ও কি বুলেটের দামে শোধ হবে?

ফিরোজ হোসেনের বয়স মাত্র ২৯, সদ্য স্নাতকোত্তর; ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা থানা এলাকায় গ্রামের কৃষি উদ্যোক্তা। গত ৯ জুন চাচাতো ভাইকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেলে ফিরোজ স্বজনদের সঙ্গে থানায় যান। দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের কাছে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেন– কী অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময় এক পুলিশ সদস্য বলে– ‘এত বড় সাহস! গ্রেপ্তারের কারণ জানতে তোরা এতদূর এসেছিস? তোদের মনে হয় বেশি তেল-চর্বি হয়ে গেছে।’ অন্য পুলিশ সদস্যরাও অকথ্য গালমন্দ ও মারধর শুরু করে। মারধরে মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থায় এক পুলিশ সদস্য চার-পাঁচ ফুট দূর থেকে ফিরোজের ডান হাতে গুলি করে। এর পর ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে অপারেশনের মাধ্যমে তাঁর হাতটি কেটে ফেলতে হয়। (সমকাল, ৩ জুলাই ২০২৪)।

প্রশ্ন হচ্ছে, ফিরোজ হোসেনকে কোন আইনে বা এখতিয়ারে পুলিশ সদস্যটি গুলি করল? পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি করে– এ বিধানটি হরহামেশা শুনিয়ে থাকেন কর্তাব্যক্তিরা। থানার ভেতরে নিরস্ত্র নাগরিককে গুলি করার ঘটনা নিয়ে পুলিশের ব্যাখ্যা কী? ফিরোজ হোসেনের প্রতি এই নৃশংসতা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। ফিরোজের অধিকার রয়েছে ন্যায়বিচার পাওয়ার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এ ধরনের নির্যাতন মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ন্যায়বিচারের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের নামান্তর।

ফিরোজ যে চাচাতো ভাইয়ের সংবাদ নিতে স্বজনদের সঙ্গে থানায় গিয়েছিলেন, তিনি পুলিশ হেফাজতে তাঁর ওপর নির্যাতনের নির্মম বর্ণনা দিয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদনে বলেছেন, ‘শৈলকুপার ওসি আমার ওপর অমানুষিক নির্যাতন করেন। এসপি তাঁর পায়ের জুতা চাটান। ওসির কক্ষে বসেই এসপি আমাকে দিয়ে তাঁর জুতা চাটান, নির্যাতন করেন।’ পুলিশ হেফাজতে আটক ব্যক্তিকে দিয়ে পায়ের জুতা চাটানোর অভিযোগকে আমরা কীভাবে দেখব? এ ধরনের অভিযোগ সভ্য সমাজে উঠতে পারে না। সমমর্যাদা আর নাগরিক অধিকারগুলো কি কেবল সংবিধানেই বর্ণিত থাকবে? শুধু তাই নয়, এ ধরনের অত্যন্ত উদ্বেগজনক অভিযোগ নাগরিক জীবনে চরম নিরাপত্তাহীনতা, উৎকণ্ঠা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আস্থাহীনতার জন্ম দিচ্ছে।
পুলিশের গুলির ঘটনায় শুধু জুন মাসেই আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। গত ৪ জুন যশোর জেলার ঝিকরগাছা থানা এলাকার শিওরদাহ পুলিশ ফাঁড়ির কনস্টেবল রোকন হোসেনের মোটরসাইকেল স্টার্ট না হওয়ায় শিওরদাহ বাজারে মেকানিক রিপনের দোকানে গেলে রিপন কনস্টেবল রোকনকে জানায়, সে এটি মেরামত করতে পারবে না। তখন পুলিশ সদস্য রোকন হোসেন মেকানিককে লাঠি দিয়ে বেদম মারধর করেন। এ সময় স্থানীয়রা এগিয়ে এলে পুলিশ সদস্য গুলি ছুড়লে সেখানে আজিজ নামে একজন ভ্যানচালক আহত হন। ২৪ জুন চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানা এলাকার মদুনাঘাট পুলিশ ফাঁড়ি থেকে ছোড়া গুলিতে স্থানীয় দুই দোকানি গুলিবিদ্ধ হন। পুলিশের পক্ষ থেকে এ ঘটনাকে অস্ত্র পরীক্ষা করতে গিয়ে ভুলবশত দু’জনের গায়ে লেগেছে বলে জানানো হয়েছে।

বাংলাদেশের সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ বলছে, ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।’ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩-তে হেফাজতে থাকা অবস্থায় কারও ওপর নির্যাতন চালানোকে অপরাধ বলে বর্ণনা করে এ জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির বিধান করা হয়েছে। ২০০৩ সালে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারা বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ে এ নিয়ে সুস্পষ্ট বাধার কথা বলা হয়েছিল। আদালতের নির্দেশনায় সুস্পষ্টভাবেই বলা হয়েছিল, হেফাজতে থাকার সময় কারও ওপর নির্যাতন করা যাবে না।

আমরা জানি, অন্যান্য আইনে যেমন ভুক্তভোগী নিজে অথবা তাঁর পরিবারকে মামলা করতে হয়, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩-তে সেই বিধানকেও শিথিল রাখা হয়েছে। আইনে যে কোনো নাগরিক আদালতে গিয়ে হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ করতে পারবেন। এ আইনে আরেকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকেই প্রমাণ করতে হবে– তিনি অপরাধ করেননি। এমন একটি আইন থাকা সত্ত্বেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করার পর ভুক্তভোগী ব্যক্তি বা তাঁর পরিবারকে ভয়ভীতির অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এ ছাড়া এখনও নির্যাতনের অভিযোগ তদন্তে কোনো স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। পুলিশই অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্ত করে। এ কারণে ভুক্তভোগী ব্যক্তি বা তার পরিবার ঘটনার প্রতিকারে আস্থা পায় না। আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না বলেই হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতন বন্ধ করা যাচ্ছে না।

আমরা আশা করব, ফিরোজের ন্যায়বিচারপ্রাপ্তিতে সব বাধা অতিক্রমে সবাই সচেষ্ট হবে। এ দেশের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো সরব এবং আইনি প্রতিকারে ফিরোজ হোসেনকে সহায়তা করতে পাশে থাকবে। সব নাগরিকের উচিত ফিরোজ হোসেনের গুলির ঘটনায় ন্যায়বিচার প্রশ্নে সোচ্চার হওয়া।
২০১৯ সালে ঢাকার কেরানীগঞ্জ এলাকায় শ্যামল নামে এক তরুণকে পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলির অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধে। বিভাগীয় তদন্তে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে সরকারি গুলি খরচের জন্য ১৫০ টাকা ট্রেজারিতে জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অথচ তরুণটি চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। আমরা আশা করব, ফিরোজের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচারপ্রাপ্তিতে কোনো পক্ষ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। গুলি খরচের জন্য ১৫০ টাকা জরিমানা দিয়ে ‘ট্রিগার হ্যাপি’ পুলিশ সদস্য যেন রেহাই না পায়।


আবু আহমেদ ফয়জুল কবির,মানবাধিকারকর্মী
প্রকাশিত লিঙ্কঃ ফিরোজকে গুলির দায়ও কি বুলেটের দামে শোধ হবে?