বলাৎকার ও ধর্ষণ একই অপরাধের ভিন্ন সাজা কেন?

বলাৎকার এবং সমকামিতা আমাদের দেশে বিদ্যমান আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু আমাদের দন্ডবিধিতে বলাৎকার এবং সমকামিতাকে অপরাধ হিসেবে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে বলাৎকারের অভিযোগ আসলে দন্ডবিধির কোন ধারার অপরাধ বলে গণ্য হয়? ইংরেজ শাসনামল হতে আমাদের দেশে বলাৎকার এবং সমকামিতাকে দন্ডবিধির ৩৭৭ ধারার অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। সেখানে অস্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক স্থাপনকে অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আইন প্রণেতারা থেকে শুরু করে এদেশের সিংহভাগ মানুষই একজন নারী এবং একজন পুরুষের মধ্যে যৌন সম্পর্ককেই স্বাভাবিক সম্পর্ক বলে গণ্য করে থাকে। সুতরাং এর বাইরে পুরুষ-পুরুষ বা নারী-নারী বা পশুর সঙ্গে মানুষ যৌন সম্পর্ককে অস্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এখানে ধর্ষণ এবং বলাৎকার প্রায় একই ধরনের কার্য হবার পরও কেন পৃথক ধারায় অভিযোগ আনা হচ্ছে? মেয়ে শিশু ধর্ষণের শিকার হলে দন্ডবিধির ৩৭৫ ধারা আর ছেলে শিশু বলাৎকারের শিকার হলে দন্ডবিধির ৩৭৭ প্রযোজ্য কেন? উভয় অপরাধই তো জোরপূর্বক কারো যৌনসঙ্গম কারো পায়ুসঙ্গম করা হয়। একই অপরাধে ভিন্ন সাজা কি অর্থে ব্যবহার করা হয়। শর্ত সাপেক্ষে ১৬ বছরের কম বয়স্ক কোন ছেলে শিশু বলাৎকারের শিকার হলে সেক্ষেত্রে দন্ডবিধির ৩৭৫-৩৭৬ ধারায় ধর্ষণের মামলা নয় বরং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ৯ ধারার অপরাধ হিসেবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বলাৎকারের শিকার শিশুটির বয়স যদি ১৬ বছরের অধিক হয় তাহলে আর তার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধকে ধর্ষণ হিসেবে মামলা করার সুযোগ থাকছে না। সেক্ষেত্রে ওই অপরাধটি তখন দন্ডবিধির ৩৭৭ ধারার অপরাধ হিসেবে দায়রা/ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দায়ের করতে হয়।

ইদানীং ছেলে শিশু যৌন নিগ্রহ বেড়ে যাওয়ায় বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। দন্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় ‘নারী ধর্ষণ’ এর অপরাধের পাশাপাশি ‘পুরুষ বলাৎকার’- কে অপরাধ হিসেবে যুক্ত ও এই ধারার সংশোধন চেয়ে গত ১৪ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী তাসমিয়া নূহাইয়া আহমেদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক ড. মাসুম বিল্লাহ এবং সমাজকর্মী ড. সৌমেন ভৌমিক হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। ওই রিটে আইন সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশের আইজিকে বিবাদী করা হয়েছে। রিটকারী পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল বলেন, সম্প্রতি দেশে ছেলে শিশু তথা পুরুষকে যৌন নির্যাতন ও বলাৎকারের ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। কিন্তু এই ধরনের নির্যাতনকে ধর্ষণের অপরাধ হিসেবে বিচার করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে আমাদের দেশে মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘটনাগুলোতে বলাৎকারের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কোমলমতি ছেলে শিশুদের ওপর এই বর্বর নির্যাতনের ঘটনা অধিকাংশই লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যায়। রিটকারী সমাজকর্মী ড. সৌমেন ভৌমিক বলেছেন, তারা দুই বছর ধরে গবেষণা করে দেখেছেন, ১৬ বছরের বেশি বয়সের ছেলে শিশু ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ ধর্ষণের শিকার হলে তারা আইনে আশ্রয় নিতে পারেন না এবং তখন ক্ষতিগ্রস্তরা ঘটনা প্রকাশ করতেও চান না। ড. ভৌমিক আরও বলেন, গত ডিসেম্বর মাসেই পুরুষ এবং ছেলে শিশুর প্রতি ধর্ষণের ২৪টি ঘটনা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সচরাচর এ ধরনের বেশিরভাগ ঘটনাই প্রকাশ হয় না বলে তিনি উল্লেখ করেন।

নিম্নে অতিসম্প্রতি এই নিষ্পাপ ছেলে শিশুদের ওপর ঘটে যাওয়া কয়েকটি নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরছি। ১০ বছরের ছোট্ট ছেলে পড়াশোনা করত মাধাবদী, নরসিংদীর স্থানীয় শিমুলেরর কান্দি দারুল আরকাম আল ইসলামিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার হেফজ বিভাগে। বেশ কিছুদিন ধরে শিশুটি জ্বরে ভুগছে। এরই মধ্যে রমজানের প্রথম দিন গত ১৪ এপ্রিল সকালে মাদরাসার শিক্ষক নজরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী মোবাইল ফোনে ছেলেকে মাদরাসায় পাঠানোর জন্য জোর করেন। ছেলের অসুস্থ থাকার কথা শিক্ষককে জানানোর পরেও ওই শিক্ষক নাছোড়বান্দার মতো আচরণ করে শিশুটির মাকে বলেন, অসুস্থ হলে প্রয়োজনে ‘পানি পড়া’ দেয়া হবে। তাকে যেন অবশ্যই মাদ্রাসায় পাঠানো হয়। শিশুটি অসুস্থ থাকায় তার মা বড় ছেলেকে দিয়ে তাকে মাদ্রাসায় পাঠান। এরপর ওই দিন দুপুর নাগাদ শিশুটি যেভাবে বাড়ি ফেরে, তা দেখে আঁতকে ওঠেন তারা। শিশুটির পরনের পোশাক রক্তে ভেজা, পুরো শরীর অবশ দেখাচ্ছিল।

শিশুটি ভয়ার্ত ও কাতর কণ্ঠে বলেন, বড় ভাই তাকে রেখে চলে আসার পর বন্ধ মাদ্রাসার একটি নির্জন কক্ষে শিক্ষক নজরুল ইসলাম তার সঙ্গে খারাপ কাজ করেছে। যন্ত্রণায় কাতর হলেও শিক্ষকের বর্বরতা থেকে রেহাই পায়নি। শিশুটির বাবা বলেন, ছেলের এমন রক্ত ভেজা শরীর দেখে আমরা স্থির থাকতে পারিনি। আমি ও আমার স্ত্রী বাঁশের লাঠি নিয়ে ঐ কুলাঙ্গারটাকে শায়েস্তা করতে মাদ্রাসায় ছুটে যাই। আমাদের বাড়ি থেকে মাদ্রাসা বেশি দূরে নয়। কারও কাছ থেকে খবর পেয়ে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আব্দুল হান্নান ও মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির কয়েকজন ঘটনাস্থলে এসে হাজির হন। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ বার বার বলতে থাকেন, যেন বিষয়টি নিয়ে বেশি হট্টগোল না করি। তিনি মিটমাট করে দেবেন। বেশি জানাজানি হলে মাদ্রাসার ইমেজ নষ্ট হয়ে যাবে। শিশুটির বাবা আরও বলেন, অনেক চাপ ও মিথ্যা প্রবোধ দেয়ার পর মাদ্রাসায় সালিশ বৈঠক ডাকা হয়। বৈঠকে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ, পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক, অভিযুক্ত শিক্ষকসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন। সালিশকারীরা শিশুটির চিকিৎসার জন্য ওষুধ ও মলম কিনে দেয়া এবং সঙ্গে খুব সামান্য টাকা নিয়ে বিষয়টি চেপে যেতে বলেন। সালিশের নামে যখন এটাকে নিয়ে চরম প্রহসন করার আয়োজন চলছিল, তখনই হঠাৎ পুলিশ এসে অপরাধীকে গ্রেপ্তার করেন ও সালিশ পন্ড হয়ে যায়। অবশ্য শিশুটির বাবা বাদী হয়ে শিক্ষক নজরুলকে আসামি করে থানায় একটি মামলা করেছিলেন। নরসিংদীর পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম বলেন, শিশুটির সঙ্গে যা হয়েছে, সেটা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ঘটনা।

কালীগঞ্জ গাজীপুর অভিযুক্ত শাহাদাত হোসেন (২৪) দুবার্টি আলীয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও তুমলিয়া জামে মসজিদের সহকারী মোয়াজ্জিন। আর বলাৎকারের শিকার শিশুটি স্থানীয় একটি মাদ্রাসার ৫ম শ্রেণীতে অধ্যয়নত। গত ৫ এপ্রিল শিশুটির বাবা স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান, শাহাদাত আরবি পড়াতে জানত তাই তাকে, আমার বাসায় এসে ছেলেকে আরবি পড়াতে বলি। কিন্তু সে বাড়ি এসে পড়াতে পারবে না, তবে সন্ধ্যার পর তার বাসায় ছেলেকে পাঠাতে বলে। তার কথামতো প্রতিদিন সন্ধ্যার পর ছেলেকে তার বাড়িতে পাঠানো হতো। আমার ছেলেসহ আরও ১০/১৫ জন ছাত্র পড়ত। শাহাদাত তার চাচার বাসার দ্বিতীয় তলায় সবাইকে পড়াত। গত ১ সপ্তাহ আগে তার ছেলে আরবি পড়তে যেতে অনিহা প্রকাশ করে এবং বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। ওই দিন পড়তে যেতে দেরি হওয়ায় বাড়িতে এসে খোঁজ নেয় শাহাদাত। পরে তার সঙ্গে পাঠানোর চেষ্টা করলে ছেলে কান্নাকাটি করে। এ সময় পরিবারের কাছে মূল ঘটনা খুলে বলে। ছেলের বরাত দিয়ে তিনি আরও জানান, প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা বাজলে অন্য ছাত্রদের ছুটি দিয়ে দিত এবং জিনের ভয় দেখিয়ে তার ছেলেকে বলাৎকার করত।

তিনি এ বলে ভয় দেখাত যে, এ ঘটনা কাউকে জানালে তার সঙ্গে থাকা জিন তার ক্ষতি করে দিবে। ছেলের বাবা আরও জানান, বিষয়টি কালীগঞ্জ পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইব্রাহিম মোল্লা, নবনির্বাচিত কাউন্সিলর আফছার আহমেদসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ-যুবলীগ নেতাদের জানানো হয়। তারা সালিশ বসিয়ে শাহাদাতকে মারধর করে। বিচারে তিনি সন্তুষ্ট না হওয়ায় তিনি গাজীপুর এসপির কাছে যাওয়ার ভয় দেখান। পরে গত ৪ এপ্রিল ২০২১ দুপুরে আবার সালিশ বসায়। এতে শাহাদাতকে সালিশকারীরা মাটিতে থুথু ফেলে চেটে তোলা, ২০ বার কান ধরে ওঠবস করা ও তাকে গ্রাম ছাড়া হতে বলে। তবে তিনি ওই কাউন্সিলরদের কথায় এবং নিজের সম্মানহানীর চিন্তা করে থানা পুলিশে যাননি বলেও জানান নির্যাতনের শিকার ওই শিশুর বাবা। (তথ্য সূত্র সংবাদ ০৬/০৪/২০২১)

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিট ৯টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার কয়েকটি অন লাইন নিউজ পোর্টাল তথ্যের ভিত্তিতে তৈরিকৃত পরিসংখ্যান থেকে, বিগত ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সালের ৮ জুন শিশু বলাৎকারের চিত্রে এই নির্যাতনের ভয়াবহতা ফুটে উঠেছে।

বিগত ২০১৭ থেকে ২০২১ (জানুয়ারি-জুন) শিশু বলাৎকার চিত্র তুলে ধরা হলো-

এই বলাৎকারের অধিকাংশই ঘটছে মাদ্রাসাগুলোতে। শুধু মাত্র ২০২১ সালের জানুয়ারি-৮ জুন পর্যন্ত ৪২ জন শিশু বলাৎবারের শিকার হয়েছে, এর ১৯ জনই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও ছয়জন শিশু মাদ্রাসার বাবুর্চি কর্তৃক। লোক লজ্জা এবং আইনি জটিলার জন্য এসব ঘটনা অপ্রকাশিতই থেকে যাচ্ছে। কোমলমতি শিশুদের ওপর ঘটে যাওয়া বলাৎকারের ঘটনা হ্রাসের জন্য পরিবারকে লোক লজ্জার ভয় উপেক্ষা করে সোচ্চার হতে হবে। আইনের ধারা পরিবর্তন ও সঠিক প্রয়োগ এবং সর্বোপরি পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে এই জঘন্য অপরাধ অনেকাংশে কমে আসবে।


লেখকঃ নার্গিস আক্তার, মানবাধিকার ও উন্নয়নকর্মী
লিঙ্কঃ বলাৎকার ও ধর্ষণ একই অপরাধের ভিন্ন সাজা কেন?