রাজধানী ঢাকায় বর্তমানে ১৬ মিলিয়ন লোকের আবাসস্থল। এক সময়ের প্রাচ্যের ভেনিস খ্যাত এ নগরী আজ বিশ্বের সবচেয়ে বসবাস-অযোগ্য নগরী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সাম্প্রতিককালের চরম মাত্রার বায়ুদূষণ এ নগরীর ১৬ মিলিয়ন মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। প্রায়শই সৃষ্টি হচ্ছে ধোঁয়াশা। ২০২১ ও ২০২২ সালে শীতকালের শুরু থেকেই বায়ুদূষণের দিক থেকে ঢাকা প্রায়ই উঠে আসছে বিশ্বের শীর্ষে। শিকাগো ইউনিভার্সিটির এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট প্রকাশিত ‘এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় পাঁচ বছর চার মাস এবং ঢাকায় কমেছে প্রায় সাত বছর সাত মাস। দেশের বাতাসে সবচেয়ে বিপজ্জনক পিএম ২.৫; যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত পরিমাণের চেয়ে ১৪ গুণ বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইটভাটা, বর্জ্য পোড়ানো, কলকারখানা ও গাড়ির কালো ধোঁয়া এ দূষণের জন্য দায়ী।
পরিবেশ অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশ হয়েছে যে, ২০১৩ সালে ঢাকায় বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা দায়ী ৫৮ শতাংশ, রোড ডাস্ট ও সয়েল ডাস্ট ১৮, যানবাহন ১০, বায়োমাস পোড়ানো ৮ এবং অন্যান্য উৎস ৬ শতাংশ দায়ী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ২০২১ সালের এক জরিপের বরাত দিয়ে সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে- বায়ুদূষণের জন্য অর্ধেক দায়ী তরল জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে তৈরি হওয়া ধোঁয়া, ৪০ শতাংশ দূষণের উৎস খড়, কাঠ, তুষের মতো জৈব ধোঁয়া ও সূক্ষ্ম ধূলিকণা এবং অবশিষ্ট ১০ শতাংশ দূষিত বস্তুকণা আসে ইটভাটায় কয়লা পোড়ানোর ধোঁয়া থেকে। অর্থাৎ বায়ুদূষণের প্রধান উৎসগুলো হচ্ছে- উন্নয়ন কর্মকান্ড, বিশেষ করে নির্মাণ কার্যক্রম, ইটভাটা, বর্জ্য পোড়ানো, কলকারখানা ও গাড়ির কালো ধোঁয়া।
চিকিৎসকদের মতে, দূষিত বস্তুকণা ফুসফুস হয়ে রক্তে চলে যায়। ফুসফুস ছাড়াও রক্তের মধ্যে গিয়ে লিভার, কিডনিসহ নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। হরমোনকেও প্রভাবিত করে এ বায়ুদূষণ। শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগ যেমন- নিউমোনিয়া, টিউবারকিউলোসিস, মাথা ঝিমঝিম, মাথা ব্যথা, বমিভাব ও গলায় ব্যথা বেড়ে যাচ্ছে এ দূষণের কারণে। বায়ুদূষণের প্রভাবে হৃৎপিন্ডের গতি বেড়ে যায়, বাড়ছে বন্ধ্যত্ব, স্নায়ুবিক দুর্বলতা, মস্তিষ্কে অক্সিজেনের ঘাটতি, কাজে অমনোযোগিতা ইত্যাদি নানা জটিলতা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা ইপির হিসাবে- কোনো শহরের বায়ুর মানের সূচক ১৫১-২০০ হলে তাকে অস্বাস্থ্যকর বলা হয়। এটি বিশেষ শ্রেণীর নগরবাসীর স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যেমন- শিশু, বৃদ্ধ ও বক্ষব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা।
বায়ুর মান বা একিউআই স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে তা খুবই অস্বাস্থ্যকর এবং তা স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয়। এ অবস্থায় শিশু, প্রবীণ ও অসুস্থ রোগীর বাড়ির ভেতরে এবং অন্যদের বাড়ির বাইরের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। বায়ুর মান ৩০০-এর বেশি থাকা মানে ওই স্থানের বায়ু ‘বিপজ্জনক’, যা সবার জন্য ক্ষতিকর। ডিসেম্বর-২০২১ এবং জানুয়ারি-২০২২ সালে ২-২৩ ঘণ্টা বায়ুর মান ৩০০ থেকে ৪৪৯-এ ছিল। বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়াল অনুযায়ী, জানুয়ারিতে বিশ্বের ১০০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান শীর্ষে ছিল আট দিন। আর চলতি মাসের ২০ দিনের মধ্যে ১১ দিনই ঢাকা বায়ুদূষণের তালিকায় এক নম্বরে ছিল। এমন পরিস্থিতিতেও কখনই জারি করা হয় না জরুরি স্বাস্থ্য-সতর্কতা। সামগ্রিক বায়ুদূষণ রোধে এখনো কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি অর্থাৎ কোনোরকম স্বাস্থ্য-সতর্কতা ছাড়াই নগরবাসী স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এবং দূষিত বায়ুই সেবন করছে। ঢাকার বায়ুমান বছরের পাঁচ মাস অস্বাস্থ্যকর থেকে বিপজ্জনক থাকে।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের দূষণ অধ্যায়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) তথ্যমতে, বিগত ছয় বছরে সর্বমোট ৩৮ দিন বিশুদ্ধ বাতাস পাওয়া গেছে; যা অর্থবছরে সাত দিনেরও কম বিশুদ্ধ বায়ু সেবন করতে পারছে এ নগরবাসী। বায়ুদূষণ পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জরুরি স্বাস্থ্য-সতর্কতা জারি করে থাকলেও এ দেশে কখনো জারি হয়নি কোনোরূপ স্বাস্থ্য-সতর্কতা। ফলে প্রতি বছর বায়ুদূষণজনিত রোগে প্রায় ১.৫৩ লাখের অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করে থাকে।
বায়ুদূষণের এ বিপজ্জনক অবস্থা থেকে নগরবাসীকে পরিত্রাণ দিতে বেলা একটি জনস্বার্থমূলক মামলা (নম্বর-২০১৪/২০২২) দায়ের করে। মামলার প্রাথমিক শুনানি শেষে ১৫ ফেব্রুয়ারি-২০২২ মহামান্য হাইকোর্ট বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ ও জনস্বাস্থ্য রক্ষায় বিবাদীদের ব্যর্থতা সংবিধান ও প্রচলিত আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হওয়ায় কেন বেআইনি, আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ও জনস্বার্থ পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চেয়ে বিবাদীদের ওপর রুল জারি করেছেন। একই সঙ্গে একটি সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং বায়ুরমান উন্নয়নের নির্দেশ কেন প্রদান করা হবে না, তাও জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত। সেই সঙ্গে বায়ুদূষণের প্রধান উৎসসমূহ চিহ্নিতকরণ ও তা হ্রাসের সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং অস্বাস্থ্যকর, অতি অস্বাস্থ্যকর ও বিপজ্জনক বায়ু থেকে জনসাধারণকে রক্ষায় অ্যালার্ট সিস্টেম প্রয়োগ এবং পোড়ানো ইটের বিকল্প কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের প্রতিবেদন আদেশ প্রাপ্তির চার মাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ প্রদান করেছেন।
লেখক : জাকিয়া সুলতানা, আইনজীবী
সৌজন্যে : আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)
প্রকাশিত লিঙ্কঃ বায়ুদূষণে দুর্বিষহ জীবন